আমার জন্ম কলকাতায় হলেও বাবা বেশ কয়েকবছর উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার হিসাবে পোস্টিং
থাকায় আমার ছেলেবেলা কেটেছে ওখানেই। উত্তরবঙ্গে ঘোরার অনেক জায়গা। অসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
চারিদিক থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
শিলিগুড়ির বি এস এফ স্কুল থেকে সিবিএসসি পরীক্ষা শেষ হলে কি হবে, জয়েন্ট এন্ট্রাস-এর চাপ ছিল। সেই জয়েন্ট শেষ হবার পর কয়েকদিনের জন্য একটু বিশ্রাম পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। শিলিগুড়িতে খুব একটা গরম পড়ে না। সকালে খুব গরম পড়লে বিকালে বৃষ্টি এসে ঠান্ডা করে দেয়। কিন্তু সেবছর উত্তরবঙ্গে টানা কয়েকটা দিন অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন ছিল। মনে হচ্ছিল, ওই গরমে কোথাও গিয়ে একটু প্রাণ জুড়োই। আমরা চার বন্ধু এমনটাই ঠিক করে বাড়িতে বললাম। বাবা বলল, ‘ঠিক আছে, কিন্তু খুব বেশিদূরে যাওয়া যাবে না। আর দু’তিনদিনের বেশি তো নয়ই’। কিন্তু কোথায় যাব?
ঠিক করলাম পড়শি রাজ্য সিকিম (sikkim) থেকেই ঘুরে আসব। মেঘ ভেসে বেড়ায় এমন এক রাজ্য। সিকিমে (sikkim) গিয়ে মনে হল, বাঙালির বলিহারি প্রতিভা। সবকিছুকেই সে নিজের মত করে বানিয়ে ইচ্ছেমত নাম বদলে নেয়। যেমন, এক্স রে আবিষ্কারক উইলিয়াম রন্টজেন নিজের নামে এক্স রে’র নাম রাখেন নি। কিন্তু বাঙালি ‘রে’ কে অভিধান মেনে ‘রশ্মি’ বানিয়ে দিল। আর রন্টজেন’কে বানিয়ে দিল রঞ্জন। দুইয়ে দুইয়ে চারে যা হয়ে গেল- রঞ্জন রশ্মি। শুরুতেই এই রঞ্জন রশ্মির কথা টেনে আনতে হল বাঙালির প্রতিভা বোঝানোর জন্য।
সিকিমের রাবাংলার (ravangla) কথাই ধরুন। যাঁরা রাবাংলার (ravangla) কথা পড়েছেন, তাঁরা অনেকেই জানেন, এর সঙ্গে বাংলার কোনও সম্পর্কই নেই। আসল উচ্চারণ হল, রাভংলা (ravangla)। বাঙালিরা নিজেদের মতো করে এর উচ্চারণ করে নিয়েছে ‘রাবাংলা’। কী আশ্চর্য, বাঙালি পর্যটকদের ভুল উচ্চারণের পাল্লায় পড়ে সেখানকার মানুষও ‘রাবাংলা’ (rabangla) বলতে ও লিখতে শুরু করেছে।
সিকিমে গিয়ে যদি প্রকৃতিকে দু’চোখ ভরে দেখতে চান, তাহলে আপনি রাবাংলা (ravangla) যেতেই পাড়েন। খরচ অল্প। দেখে মনও ভরবে। সিকিম (sikkim) বলতে অধিকাংশ পর্যটক ছুটে যান গ্যাংটকে (gangtok)। সেখান থেকে বরফ দেখার আশায় ছাঙ্গু বা আরও দুর্গম পথে যেতে চাইলে নাথুলা। কিন্তু যাঁরা অতটা ধকল নিতে চান না, অথচ প্রকৃতিকে দারুণভাবে উপভোগ করতে চান, তাঁদের ঠিকানা হতে পারে রাবাংলা।
কীভাবে যাবেন? যদি গ্যাংটক থেকে যেতে চান, তাহলে ৬৫ কিমি রাস্তা যেতে দু’ঘন্টার মত লাগবে। আর
যদি শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি যেতে চান, তাহলে ১১০ কিমি। সময় লাগবে মোটামুটি সাড়ে চার ঘন্টা
আপনি আলাদা গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। আবার আমাদের মতো খরচ বাঁচাতে শেয়ারেও যেতে পারেন।
উচ্চতা সাত হাজার ফুটেরও বেশি। ওঠার পথটা এতটাই সুন্দর, আর অন্য কোথাও না গেলেও চলবে।
পাহাড়ের গা বেয়ে অনেক ঝর্না নেমে আসছে আপন খেয়ালে। জানলা দিয়ে ভেসে আসছে মেঘ। রাবাংলা একেবারেই ছোট শহর। পায়ে হেঁটে দিব্যি ঘোরা যায়। অহেতুক গাড়ি নেবেন না। গাড়ি নেওয়া মানে অনেক আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া। পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছিলাম বুদ্ধ পার্কের (buddha park, ravangla) দিকে (তবে একান্তই না পারলে গাড়ি নিতে পারেন)।
নিসর্গ তো আছেই, তার সঙ্গে চমৎকার সাজানো একটি বিশাল পার্ক। বিশাল এক বুদ্ধ মূর্তি। আর কোথাও যদি যেতে না পারেন, এই পার্ক ও লাগোয়া মনাস্ট্রিতে অবশ্যই যান। নামার সময় দরকার হলে হেঁটে নামুন। দেখলাম যাঁরা গাড়ি নিয়ে এসেছেন, অনেকেই রালং, ভলিং, টুমলং মনাস্ট্রি ঘুরতে চলে যাচ্ছেন। কাছেই টেমি চা বাগান থেকে আমরা ঘুরে এলাম। আরও অনেক অজানা জায়গা আছে। অন্ততঃ দু’দিন না থাকলে জায়গাটা ভালভাবে ঘোরা হবে না। কিন্তু আমাদের তো হাত পা বাঁধা।
তাই যদি লম্বা ছুটি থাকে, আপনি নামচি, পেলিংয়েও (peling) দু’একদিন সময় কাটিয়ে আস্তে পারেন। আবার যদি মনে করেন, এবার শুধু রাবাংলা (ravangla) থেকেই ফিরে আসবেন, তাতেও ক্ষতি নেই। যেতে পারেন শীতের সময়েও। কারন, ঠান্ডাতেই ঠান্ডা জায়গার মহিমা অনুভব হয়।
তবে, বসন্ত কিংবা গ্রীষ্মে পাহাড়ের দেশে ঘুরে এসেও দারুণ আনন্দ পাওয়া যায়। যেমন আমরা চারমূর্তি পেয়েছিলাম।