সাঁচির পাথরে, শান্তির সাগরে

on Sanchi Stupa, Madhya Pradesh

0
346
Sanchi Stupa

বৌদ্ধধর্মকে যাঁরা শ্রদ্ধা করেন ও ভালোবাসেন, মধ্যপ্রদেশের সাঁচি (sanchi) তাঁদের কাছে স্বর্গের মতো এক পবিত্র পীঠস্থান। ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে বড় আবেগের জায়গা। আর শিল্পপ্রেমীদের কাছে পাথর খোদাই করে তৈরি পুরাকালের শিল্পের এক অসাধারণ আকর। যার মধ্যে সাঁচি স্তুপ (sanchi stupa) বা গ্রেট স্তুপ (great stupa) পাথরের কাঠামোয় সবচেয়ে প্রাচীন ও অভূতপুর্ব সৃষ্টি। 

বৌদ্ধধর্ম পৃথিবীর এই প্রান্তে অনেক আদিতে শাখা প্রশাখা বিস্তার করলেও মানচিত্রে ঠাঁই হয়নি। ব্রিটিশ অফিসার জেনারেল টেলর ঐতিহাসিক কলাকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে সাঁচির (sanchi) গ্রেট স্তুপকে নবজন্ম দিলেন। এরপরেই সাঁচির দুনিয়া জোড়া খ্যাতির শুরু। ১৯৮৯ সালে ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর স্বীকৃতি পায়। ভোপাল (bhopal) থেকে সাঁচি (sanchi) ৪৪ কিমি দূরে। 

দু’দিন হল এসেছি। মধ্যপ্রদেশ (madhya pradesh) ট্যুরিজিমের ‘গেটওয়ে রিট্রিয়ট গেস্টহাউস’-এ উঠেছি। বেশ ভাল ব্যবস্থা। তাছাড়া ভোপাল (bhopal) শহর থেকে খুব কাছে অথচ শহরের কোলাহল বর্জিত। প্রথম দিনটা মালবের রাজধানী বিদিশায় কাটিয়েছি। আজ চলেছি গ্রেট স্তুপ (great stupa) দেখতে। এটা এক নম্বর স্তুপ। আছে আরও তিন স্তুপ। তবে এক নম্বর স্তুপই প্রধান। এছাড়া আছে আরও কিছু দ্রষ্টব্য স্থান। বাসে যাচ্ছি। দেড় ঘন্টার মতো লাগে। জানালার ধারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে সাঁচির কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে পৌঁছে গেছি বুঝতেই পারিনি। সামনে দাঁড়ানো কন্ডাক্টরের ‘বাবুজি’ ডাকে হুঁশ ফিরল।

বাস থেকে নেমে দেখলাম আমার আগে যাঁরা হাঁটছে, সকলেই ট্যুরিস্ট। এদের মধ্যে বিদেশীরাও আছেন। আমার প্রথম কাজ একজন ভাল গাইড ঠিক করা। দু’পা এগোতে তেমন একজনকে পেয়েও গেলাম। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। বছর তিরিশের এক যুবকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে আমাকে দেখে হেসে বলল, ‘ওয়েলকাম টু সাঁচি স্যার, বাঙালি তো? আমি বিলাস বিশ্বাস, এখানকার একমাত্র বাঙালি গাইড’। চমকালেও বেশ খুশিই হলাম।

পাহাড়ের ৩০০ ফুট উপরে সাঁচি স্তুপ বা গ্রেট স্তুপ। খ্রীস্টপুর্ব তৃতীয় শতকে যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সম্রাট অশোক। নির্মান হয় ৭১ ফুট উচ্চতার স্তুপ। নির্মান কাজ তদারকি করেন অশোক জায়া রানী দেবী ও কন্যা বিদিশা। ভাবতে পারেন, সে যুগে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে রানী ও রাজকন্যা নির্মাণকাজ তদারকি করছেন! বালি দিয়ে তৈরি পাথুরে ইঁটের গাঁথনি, স্তুপের বাইরে শঙ্খলিপি। উপর থেকে নিচে তাকালেই চোখ জুড়ানো সবুজ ঘাসের গালিচা। বলেই ফেললাম, দারুণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তো! ‘হ্যাঁ স্যার, শুধু এই স্তুপ নয়, এখানকার সব জায়গাই খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একটা আলপিন পর্যন্ত পড়ে থাকতে দেখবেন না। তবে সাঁচি স্তুপ (sanchi stupa) রক্ষনাণাবেক্ষন করে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া(এ এস আই)’। 

জেনে রাখুন, সাঁচি স্তুপের (sanchi stupa) চার দুয়ার। পূব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ। প্রত্যেকটা গেট সেই খ্রীস্ট পূর্ব ৩৫ শতক থেকে ভগবান বুদ্ধের জীবনের বিশেষ কিছু ঘটনায় সমৃদ্ধ। যেমন, পূবের গেটে গৌতম বুদ্ধর প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাওয়া ও জননী মহামায়া বা মায়ার কথা। তবে আমরা শুধু গ্রেট স্তূপই ভাল করে ঘুরে দেখেছি। আগেই বলেছি এটাই প্রধান স্তুপ। সাঁচির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। অনেকেই পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন। ছোটদের জন্য সাঁচি এক আদর্শ শিক্ষামূলক ভ্রমণ হতে পারে। 

অপরূপ ভাস্কর্য কিংবা স্তুপের ভেতরের এক ঝাঁক পায়রা দেখে- যেন হারিয়ে যেতে নেই মানা। বুদ্ধের স্মরণে সুযোগ পেলে একবার সাঁচি ঘুরে আসুন। বুঝবেন, এ বড় শান্তিরজায়গা। ক্রংক্রিটের শহর থেকে এসে আপনি হয়ত নিজের অজান্তেই স্বগতোক্তি করে ফেলবেন – বুদ্ধম শরনম গচ্ছামি। শত কোটি প্রণাম অর্পন করে সাঁচি স্তুপ (sanchi stupa) থেকে নেমে এবার যাচ্ছি উদয়গিরি (udaygiri) গুহা দেখতে। পেছন ফিরে দেখলাম, দূর থেকেও সাঁচি সত্যিই আশ্চর্যরকমের সুন্দর।

উদয়গিরি (udaygiri) গুহা অতীতের বহুমুখী শিল্প সুষমা দেখার মত আনন্দ বোধহয় অন্য কিছুতে নেই। সৃষ্টি তার অহংকার নিয়ে বিরাজ করুক, কিংবা ধ্বংসের কান্নায় আয়না ধরুক, এই দৃশ্যসুখ আপনার নজর কাড়বেই। অতীত আপনাকে কল্পনা কিংবা বাস্তব যে জগতেই ভাসাক এখানে আপনি দেবদূত ও শয়তানের সহবস্থান দেখতে পাবেন। জয় ও পরাজয় দেখতে পাবেন। দেখতে পাবেন ইতিহাসের বরেণ্যদের পাশাপাশি হিংস্র খলনায়কদেরও। উদয়গিরি গুহা এই সবকিছুরই যেন এক কমপ্লিট প্যাকেজ। মোট ২০টা গুহা। যা অতীতের বর্ণময় খন্ড খন্ড চিত্র দিয়ে সাজানো। 

গুহাতে গুপ্ত রাজত্বের ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দী সময়কাল পর্যন্ত নিখুঁত ভাস্কর্যর সমাহারে দেখে নিন হিন্দুত্ব ও জৈনবাদের নানা কাহিনী। উদয়গিরি গুহা দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল, এই বিশাল ভারতবর্ষে কত যে অকল্পনীয় কীর্তি ছড়িয়ে রয়েছে। যার আমরা কতটুকুই বা জানি?

গাইড বিলাস বোধহয় আমার মনের বিলাসিতার তল খুঁজে পেতেই জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার বেলা হয়েছে, লাঞ্চ করবেন তো?’ বললাম, এখানে লাঞ্চ করব কোথায়! বিশাল ‘আশ্চর্য প্রদীপের আজ্ঞাবহ দৈত্যের মত বলল, ‘আপনি অনুমতি করলেই ব্যবস্থা হবে স্যার’। হেসে বললাম, তাহলে ব্যাবস্থা করুন।

আমরা ওখানেই একটা হোটেলে গেলাম। ‘গ্রেট বোওল’ পাথর দিয়ে তৈরি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন হোটেল। গাইড বলল, ‘স্যার, এখানকার স্নানঘরটা খুব ভাল। জানি, আপনি স্নান তো করবেন না, কিন্তু মুখে চোখে জল দিয়ে একটু ফ্রেশ হতে পারেন’। এখানকার সব কিছুই বেশ রুচিসম্মত। আপনি খাবার পছন্দ করে অর্ডার দিন। বৌদ্ধ সন্নাসীরা কন্টেনারের মধ্যে বোওলে রাখা খাবার আপনাকে পরিবেশন করবেন। লাঞ্চ সেরে ঘণ্টাখানেক গ্রেট বোওল-এ কাটিয়ে আবার অচেনার আনন্দের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এবার অশোক স্তম্ভ (pillars of ashoka)।

সম্রাট অশোকের জীবন ছিল বৈচিত্রময়। যা নিয়ে আছে অনেক গল্প। কলিঙ্গ যুদ্ধ শেষে প্রবল পরাক্রমী সম্রাট নিজের অত্যাচারের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হয়েছিল, এ তিনি কী করছেন! এত রক্ত, এত হত্যা! অনুতাপে দগ্ধ সম্রাট অশোক বুদ্ধ মূর্তির পায়ের নিচে পড়ে অঝোরে চোখের জল ফেলেছিলেন। ভগবান বুদ্ধের কাছে নতমস্তকে বলেছিলেন- হে প্রভু আমাকে তুমি ভাল মানুষ হওয়ার শক্তি দাও, সংযম দাও। বলেছিলেন- প্রভু, তুমি আমাকে আর কিছু না দাও, তোমার পায়ের একটা নখ ভিক্ষা দাও। কথিত আছে, অত্যাচারী ভাবমূর্তির বোঝা অশোকের কাছে এতটাই অসহনীয় হয়েছিল যে, নিজেকে আকাশের তারাদের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। 

নিজের সাম্রাজ্য জুড়ে স্তুপ, স্তম্ভ নির্মাণ করে বুদ্ধকে উৎসর্গ করেছিলেন। উচ্চতায় ৪০ফুট। দক্ষিণ গেটওয়ের সাঁচি স্তুপের (sanchi stupa) কাছে দেখে নিন পৃথিবী বিখ্যাত সেই অশোক স্তম্ভ। অপূর্ব ভাস্কর্য। গ্রিকো বুদ্ধিস্ট স্টাইলে নির্মিত চার সিংহ বিশিষ্ট অশোক স্তম্ভ। বিস্ময়কর হল, খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে নির্মাণ হওয়া স্তম্ভের ঝাঁ চকচকে পালিশ এখনও অটুট। মনে হয় যেন আজই পালিশ করা হয়েছে! অশোক স্তম্ভ দেখে বললাম, বিলাস, এবার কি মিউজিয়াম?

মিউজিয়ামঃ সাঁচি (sanchi museum) নিয়ে বেশী কিছু জানতে হলে আপনাকে মিউজিয়ামে যেতেই হবে। এই মিউজিয়াম ২০০০ বছরের পুরনো। অসাধারণ সব চোখ ধাঁধানো সংগ্রহ। হাতে সময় থাকলে, নানা সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান কেমন ছিল ইচ্ছা করলে জেনে নিতে পারেন। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এবার গুপ্ত মন্দির দর্শনে যাচ্ছি।

গুপ্ত মন্দিরঃ গুপ্ত টেম্পল (Gupta temple) বা মন্দির খ্রীস্ট মৃত্যুর পঞ্চম দশকের নির্মান। এই মন্দির গুপ্তযুগের ভাস্কর্য শিল্পের এক অসাধারণ কীর্তি। যা নানা ধর্মের বিশ্বাসী মানুষজনের মধ্যে আর্বতিত হয়ে জন্ম দিয়েছে সংহতির। ফলস্বরূপ সব ধর্মের মানুষের জন্য মন্দির তৈরির জমিটাই তো বৌদ্ধধর্ম কেন্দ্রের। দেশের যে কোনও মন্দিরের কাঠামোর সঙ্গে গুপ্ত মন্দিরের কাঠামোর মধ্যে কোনওভাবেই কোনও মিল খুঁজে পাবেন না। অনেকটা ফাঁকা জমির উপর ছোটখাট অতি সাদামাটা একটা একতলা বাড়ি। মন্দিরের সামনে চারটি কার্ভিং পিলার।

কিংবদন্তী পুরাতত্ববিদ জন মার্শালের কাছে মন্দিরের এই আদল খুবই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যা নামছে। এখানে নভেম্বর মাসে ভালই ঠান্ডা পড়ে। ঘুরতে হবে বলে শীতের পোষাক নিয়ে বেরোইনি। তবে ফেবুয়ারি, মার্চ, অক্টোবর ও ডিসেম্বরও সিজন। গাইড বিলাস বিশ্বাসকে বিদায় জানাতে হবে। বিলাস বলল, ‘স্যার, আপনি তো কাল কলকাতায় চলে যাবেন। কিন্তু এখানে আরও কিছু দেখার জায়গা আছে। যেমন, কনক সাগর পন্ড, সাঁচি উদ্যান (sanchi garden), কামাপারা হনুমান মন্দির, বুদ্ধিস্ট মন্দির, ছেতিয়াগিরি বুদ্ধিস্ট মন্দির। জায়গাগুলো সবাই যে যায় এমন নয়। আসলে দুটো দিন হাতে নিয়ে এলে যাওয়া যায়। 

এরপর পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বলল, ‘হোটেলে ফিরবেন তো, চলুন আপনাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি’। যেতে না যেতেই একটু দূরে দেখলাম বাস আসছে। বিলাসের হাত দুটো ধরে বললাম, আজকের দিনটা আপনার জন্য খুব ভাল কাটালাম। বিলাস হাসল। দেখলাম বিলাসের চোখ দুটো ছল ছল করছে। বাস এসে গেছে, বিলাস বলল, ‘আবার আসবেন স্যার’। অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আমাকে তুলে নিয়ে বাস চলতে শুরু করল। শুনতে পেলাম, বিলাসের শেষ কথাগুলো। ‘সাবধানে যাবেন, আর ভাল থাকবেন স্যার। খুব ভাল থাকবেন’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here