Bhutan: ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণ

0
140
Bhutan

খুব শখ করেই পাসপোর্ট করিয়েছিলাম। যদি কোনওদিন কাজে লাগে! কালাপানি পেরোব এমন আশা করিনি। কিন্তু প্রতিবেশী দেশে তো যেতেই পারি। অন্ততঃপক্ষে বাংলাদেশ। 

না! সেখানেও যাবার সৌভাগ্য এখনও অর্জন করিনি। তাই পাসপোর্ট যেমনকার তেমনই আছে। কোথাও কোনও ছাপ পড়েনি। বেশ কিছুদিন হল বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছি। তবে অত শখ করে বানানো পাসপোর্ট কোনও কাজেই লাগেনি।

এবার আসল কথায় আসি। আমার পতিদেবের প্রস্তাবে গিয়েছিলাম ভুটান। যদিও সেটা ছিল কয়েক ঘন্টার ঝটিকা বিদেশ সফর। আমরা সেবার গিয়েছিলাম ডুয়ার্সে। উঠেছিলাম রাজভাতখাওয়ায়। শুনলাম, দেড় ঘন্টায় নাকি ভুটান (Bhutan) পৌঁছনো যায়। যেতে আসতে খরচ মাত্র একশো টাকা। এত কাছে এসে, এত সস্তায় বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে!

খুব ভোরবেলায় লোকাল ট্রেন ধরে হাসিমারা। সেখান থেকে অটোয় জয়গাঁ। জয়গাঁ হল সীমান্ত শহর। পায়ে হেঁটে ওপারে গেলেই ভুটান (Bhutan)। ঘড়িতে তখন সকাল আটটা। দুই দেশের ঘুম ভাঙলেও শীত ঘুমের আমেজ তখনও কাটেনি। যেখানে নামলাম সেখান থেকে তাকিয়ে দেখি অনেকটা ইন্ডিয়া গেটের মত দেখতে একটা গেট। এপারে ভারত। ওপারে ভুটান (Bhutan)। 

কী অদ্ভূত রোমাঞ্চ! এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাওয়ার মতোই, এক দেশ থেকে নিঃশব্দে আরেক দেশে পৌঁছে গেলাম। যাই হোক, এদেশ থেকে ওদেশে যে ঢুকলাম, কেউ একবারও চেক করল না। পাসপোর্ট ব্যাগেই থেকে গেল। কর্তাকে বললাম, এ কেমন দেশ! এত অনায়াসে আরেকটা দেশে ঢোকা যায়? হ্যাঁ এইভাবেই হাজার হাজার মানুষ এদেশ-ওদেশ করছে। সীমান্তে কখনও ভোটার কার্ড দেখে, কখনও দেখে না। তবে, সঙ্গে রাখা ভাল। 

আমি এই প্রথম নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে এলাম। সে কী আনন্দ! কী অদ্ভূত একটা রোমাঞ্চ সাতসকালে তাড়া করছে। সীমান্তের দুই পারে যেন দু’রকম ছবি। একদিকে জয়গাঁ এক ঘিঞ্জি শহর। অন্যদিকে, ফুন্টশেলিং (phuntsholing) ঝকঝকে তকতকে। নিজের দেশের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, পরিচ্ছন্নতার নিরিখে ‘স্বচ্ছ ভারত’ যেন পুঁচকে ভুটানের কাছে দশ গোল খাবে। ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছি। চারিদিকে ভুটানি ভাস্কর্য, চোখ ফেরানোই যায় না। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব! এমন সময় দেখি, আমার পতিদেব ছোট্ট এক লামার সঙ্গে বেশ জমিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। 

মুহূর্তের মধ্যে মুহূর্তটা লেন্স বন্দী করে ফেললাম। আনাদের গন্তব্য ফুন্টশেলিং-এর (phuntsholing) এক বহু পুরোনো বৌদ্ধ গুম্ফা। কিন্তু তার আগে দেশী পেটে বিদেশী খিদে মেটাতে আমরা একটা ছোট্ট অথচ সুন্দর দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। ভুটানি ম্যাগি আর মোমো সহযোগে আমরা উপবাস ভঙ্গ করলাম। ম্যাগিটার সবই ভাল। কিন্তু কেমন যেন টক টক। তবে সব মিলিয়ে বেশ ভালই।

আগেই বলেছি আমরা কয়েক ঘন্টার ঝটিকা সফরে গিয়েছিলাম। তাই ওখানকার স্ট্যান্ড থেকে একটা  গাড়িতে চলে গেলাম ফুন্টশেলিং (phuntsholing)। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ক্রমশ ওপর দিকে উঠছি। সব পাহাড়ি জায়গার  চরিত্র ও সৌন্দর্য বোধহয় একই। বেশিদূর যেতে হল না। তার আগেই পৌঁছে গেলাম গুম্ফায়। চারপাশটা দেখে মন ভরে গেল। এত সুন্দর, এত নির্জন একটা পাহাড়ি উপত্যকা। কোনও বাড়তি আড়ম্বর নেই। এমন একটা জায়গায় আসার কথা কতদিন ধরে যে মনের মধ্যে লালন করেছি। আসলে মানুষ যা চায় তাই পায়। শুধু সেই ভাবনাটার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হয়।

চারিদিকে লোকজন নেই বললেই চলে। শান্ত, স্নিগ্ধ নির্জন এক বৌদ্ধ মন্দির। চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। ফুলে ফলে সৌন্দর্য ভরে আছে জায়গাটা। মন্দির তখনও খোলেনি। এদিক ওদিক ঘুরছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল নানান বয়সী একদল লামা। কী প্রাণবন্ত! কাজ করছে, খেলছে, দুষ্টুমি করছে। একসঙ্গে সবাই বড় হচ্ছে। এখনকার বাচ্ছাদের মত হাতে স্মার্ট ফোন নিয়ে জ্যাঠাগিরি নেই।

একটা লামা দেখি মুখের ভেতর এক অদ্ভূত শব্দ করছে। অথচ ঠোঁট নড়ছে না। গারগেল করলে যেরকম আওয়াজ হয়, অনেকটা সেরকম। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম- ইয়ে কেয়া কার রাহে হো? সে জানাল- ইয়ে পূজা হ্যায়। ওদের দেখতে বেশ মজা লাগছিল। সবচেয়ে ছোট ছেলেগুলোই বেশি মুরুব্বি। হাবভাব চালচলন দেখে মনে হচ্ছিল অতিশয় ডেঁপো ছোকরা।

ওপর থেকে নিচের জনবসতি দেখা যাচ্ছিল। আর ওই দূরে দেখা যায় শুকিয়ে যাওয়া নদী তোর্সা। আমরা ঘুরতে ঘুরতে এক গুলঞ্চ গাছের নিচে এসে বসে পড়লাম। চারিদিকে ফুলের সুগন্ধ। কী অদ্ভূত শান্তি! পবিত্র নীরবতা! পাখির কুজন! সব মিলিয়ে যেন স্বর্গরাজ্য। কত গাছ চারিদিকে। ইচ্ছা করছিল প্রত্যেকটা গাছ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। তাদের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। অনন্ত নীরবতার সঙ্গে থাকতে থাকতে হয়ত ওরাও কিছু বলতে চায়।

চোখে পড়ল জনৈক এক ভুটানি ভদ্রলোক রোদে বসে ফোনে কথা বলছে। আর তাঁর পিঠে অদ্ভূত কায়দায় বাঁধা আছে তাঁর শিশু সন্তান। কান্নাকাটির বালাই নেই। সেও অবাক বিস্ময়ে এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ পান করছে। ওইরকম একটা জায়গা থেকে আসতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু আসতেই হবে। ফেরার পথে কুমীর বিভ্রাট দেখতে গেলাম। টিকিট কেটে ঢুকে দেখি অসংখ্য কুমীর রোদ্দুরে শুয়ে আছে। জ্যান্ত না মৃত দেখে বোঝার উপায় নেই। যেভাবে নিশ্চিন্তে এরা দিন কাটাচ্ছে তা দেখে মনে হল, ওরা অন্ততঃ মানুষের থেকে ভাল আছে। 

যে টিকিট দিচ্ছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- এরা জীবিত না মৃত? লোকটা আমার ওপর প্রচন্ড রেগে গিয়ে কী সব বলে উঠল কে জানে। বেরোতে যাব, এমন সময় দেখি টমেটো টাইপের একটা বাচ্চা ভুটানি ছেলে। হাতে একটা পপকর্ণ-এর প্যাকেট। গাছ আর লোহার বেড়ার বাইরে খুব অল্প জায়গা। তার মধ্যে দিয়ে শরীরটাকে পার করার চেষ্টা করছে। আমরা দেখে খুব একচোট হাসলাম। ছবি তোলার পোজ দিতে বলায় সুন্দর করে দিয়ে দিল।

যাই হোক, পাহাড় থেকে সমতলে নেমে এলাম। এটা সেটার দোকান ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ্য করলাম, সব দোকানেই রাজা রানীর ছবি রয়েছে। হোটেল, রেঁস্তোরা, বা বলতে গেলে সব ধরণের ব্যাবসায় ছবি রাখা বাধ্যতামূলক। ভুটানের (Bhutan) মানুষ রাজাকে ভগবান জ্ঞানেই পুজো করে। তবে ওদের পোষাকগুলো বড়ই অদ্ভূত। বিশেষতঃ ছেলেদের। আমাদের এখানকার ওভারকোটের মতই। কিন্তু হাঁটুতে নামার অনেক আগেই তা ফুরিয়ে গেছে। যারা অফিস কাছারি যায় তাঁরা আবার ওই ওভারকোটের পর হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মোজা পরেছে। যেমন ফুটবল খেলোয়াড়রা হোর্স পরে সেইরকম।

ইচ্ছে ছিল সকলের জন্য বিদেশ ভ্রমণের কিছু স্মারক চিহ্ন কিনব। কিন্তু দাম শুনেই ব্যাগ খুলে বুঝলাম এ যাত্রায় ইচ্ছাপূরণ হবে না। তাই সকলের জন্য ভুটানি ম্যাগি, অন্ধকারে আলো জ্বলে এমন কিছু চকোলেট, আর গুটিকয়েক ভুটানি কোল্ডড্রিঙ্কস কিনলাম। 

তখনই দেখলাম, আমাদের দেশের এক ভদ্রলোক যেই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরাতে যাবেন, রে রে করে এক দোকানদার ছুটে এসে তার মুখ থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে বললেন- স্যার, ইধার স্মোকিং নেহি চলেগা। ভুটানে (Bhutan) ধূমপান নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে জরিমানা ও হাজতবাস কেউ আটকাতে পারবে না। ভুটানে হোটেল ভাড়াও অনেক বেশি। তাই একটা পুরো দিন বিদেশের কাটানোর ইচ্ছাও ত্যাগ করে টুক করে দেশে ফিরে এলাম।

শুধু আমার দেশের পরেই নয়, সকল দেশের পরেই ঠেকাই মাথা। কাজেই ভিসা পাসপোর্ট না থাকলেও বিদেশ ভ্রমণের এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here