পাহাড়ের মাঝে জঙ্গলঘেরা সেই শুনশান ঠিকানা

0
165
টিভিতে পাহাড় দেখলেই মনটা উড়ু উড়ু করে। মনে হয় একবার যদি যেতে পারতাম! জঙ্গলের কথা মনে পড়লে মনে হয় এই জন অরণ্য ছেড়ে কবে সবুজ অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে যাব! রংবেরঙের পাখি দেখবো। গাছের পাতা ঝরার গান শুনব। আবার নদীর ওপর দিয়ে পেরিয়ে যেতে যেতে মনে হত এমন যদি একটা জায়গা পেতাম যেখানে গভীর জঙ্গল। ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে এক খরস্রোতা নদী। নদীর পাথরের উপর চুপ করে বসে আছি। পা ভিজিয়ে দিয়ে সে নদী আপনবেগে পাগলপারা হয়ে বয়ে চলেছে। এখন কম্বোর যুগ। চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস নিলে কোলড্রিংক ফ্রি। দুটো জিন্‌স কিনলে একটা টি শার্ট ফ্রি। কিন্তু জঙ্গল আর নদীর খোঁজে গেলে পাহাড় যদি কম্বো হিসেবে ফ্রি পাওয়া যায় তাহলে তো পুরোটাই জমে ক্ষীর। আসলে পাহাড়, নদী আর জঙ্গল একসঙ্গে পাওয়া মনে হয় শুধু স্বপ্নেই সম্ভব।
কিন্তু স্বপ্নও তো কখনও বাস্তব হয়। এমন একটা জায়গার খোঁজ অবশেষে পাওয়া গেল। বেশি ভনিতা না করে সোজা কথা সোজা ভাবে বলাই ভাল। জায়গার নাম সুনতালেখোলা। গুগুল মহাশয় যেসব ছবি দেখিয়েছিলেন তাতে অবশ্য জায়গাটি আহামরি মনে হয়নি। তবে জায়গাটিতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কটেজ। সেদিক থেকে জায়গাটি যে অসাধারণ হবে অনুমান করাই যায়। কারণ পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে সুন্দর জায়গা গুলিতেই রয়েছে বনদপ্তরের কটেজ। তাই একরাশ দোলাচলতায় ভর করে নভেম্বরের শেষ নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম সুনতালেখোলার উদ্দেশ্যে। মালবাজার থেকে চালসা। সেখান থেকে গাড়ি করে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে উঠছি। কিছুটা পথ পেরনোর পর থেকেই জনবসতি একেবারে কমে এল। এবড়ো খেবড়ো পথ। দুপাশে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর শীতের দাপটও বেশি। দেখতে দেখতে যেখানে এসে গাড়ি থামলো বাইরেটা তাকিয়ে দেখে প্রথমে একটু অবজ্ঞা মিশ্রিত বিস্ময়ই প্রকাশ করেছিলাম- এইটা সুনতালেখোলা! কিন্তু গাড়ি থেকে নেমেই সব অবজ্ঞা এক লহমায় ধুলিস্যাৎ গেল। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই গভীর জঙ্গল। সামনেই রয়েছে লছমন ঝোলার মত দড়ির তৈরি এক ঝুলন্ত ব্রিজ। তার তলা দিয়েই বয়ে চলেছে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী সুনতালে । সেই ব্রিজ পেরোতেই চোখে পড়ল অনেকখানি ঘেরা জায়গার মধ্যে অবস্থিত সরকারি কটেজগুলি। আগে থেকেই বুকিং করে এসেছিলাম। তাই থাকার কোনও অসুবিধে হয়নি। বারো থেকে তেরোটার মত ছবির মত সাজানো কটেজ। ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন গাছ গাছালির সুন্দর বাগান। একটু দূরেই ক্যান্টিন। কটেজের পেছনেই খুব জোর দশ হাত দূরেই শুরু হয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। আর তেমনি গভীর জঙ্গল। দিনের বেলায় তো চারিদিক দেখেই মন একেবারে আনন্দে নেচে উঠল। পাহাড়ি ঝর্ণার জলে স্নান করে টুকটাক খেয়েই বেড়াতে বেরিয়ে পড়লাম।
River Camp
শিশুর মত আনন্দ হচ্ছিল। পাহাড়, তার কোলে ওইরকম গভীর জঙ্গল, আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। এই দৃশ্যতো মনে মনে কল্পনা করতাম। বাস্তবে যে এমন জায়গা সত্যিই আছে তা জানতাম না। নদীটাকে দেখে মনে হল সে যেন কতদিনের পরিচিত। আমার বড় আপনজন। তাই তার কাছে গিয়ে একটা পাথরের উপর বসে পা ভিজিয়ে দিলাম তার জলে। হাড় হিম করা ঠাণ্ডা সে জল। শরীর মন শীতল হয়ে গেল। মনের গ্লানিও যেন অনেক খানি ধুয়ে গেল। নদীটাকে দেখে ভাবছিলাম কত পাথরের বাধা পেরিয়ে কত জনপদ পেরিয়ে সে বয়ে চলেছে আপনমনে। জলটা কাঁচের মত স্বচ্ছ। নদীর গর্ভে কত রংবেরঙের পাথর।
নদী থেকে উঠে গেলাম রিভার ক্যাম্পে। সেই জায়গাটা আরও সুন্দর। যারা অতিরিক্ত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় তাদের জন্যেই এই জায়গা। নদীর পাশেই খাটানো রয়েছে বেশ কয়েকটা টেন্ট বা তাঁবু। রাত্রিযাপন সেই তাঁবুর ভেতরেই। জায়গাটা দেখে আর রাত্রি বেলায় এরকম একটা জায়গায় থাকার  কথা ভেবে হাড় হিম হয়ে গেল। জঙ্গলটা এতটাই গভীর যে সূর্যের আলো এসে পৌঁছয় অনেক কষ্টে। পৌঁছলেও সে ক্ষণিকের অতিথি। যদিও আমরা যেসময় গিয়েছিলাম সেসময় রিভার ক্যাম্প বন্ধ ছিল। আরও উন্নত করার কাজ চলছিল।
দুপুর বেলায় নেপালী রান্না খেয়ে একচোট ঘুম। শীতের বিকেল। তার ওপর পাহাড় আর জঙ্গলে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে আসে। শীতের আলস্য কাটিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখলাম সন্ধ্যা নামছে। টুং টুং করে ঘণ্টার আওয়াজ।  গরু বাছুর নিজের আস্তানায় ফিরে যাচ্ছে। ঘড়িতে সময় তখন মাত্র সাড়ে চারটে। গুটিকয়েক লোকজন। কটেজগুলোও বেশ ফাঁকা। দু একটাতে লাইট জ্বলছে দেখে ভরসা পেলাম। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে চারিদিক ঘন অন্ধকার ঘনিয়ে এল। ত্রিসীমানায় কোনও জনবসতি নেই। কটেজের দু চারজন কেয়ার টেকারই তখন একমাত্র ভরসা। ওপর দিকে তাকালে এবং দৃষ্টিশক্তি ভাল থাকলে বোঝা যাবে যে বেশ কয়েকটি লাইট জ্বলছে। সোলার লাইট হওয়াতে তার আলো যথেষ্ট ক্ষীণ। বাগানের সাজানো গাছগাছালির মধ্যে চেয়ার টেবিলে বসে গরমগরম পকোড়া সহযোগে চা খেয়ে মনে একটু সাহস আনার চেষ্টা করলাম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। বাড়তে থাকে ঠাণ্ডার দাপট। নদীর একটানা কুলুকুলু শব্দ তখন মনে হয় ঘুমপাড়ানি গান। সকাল বেলায় যে জায়গা গুলোতে হেসে খেলে ঘুরে বেড়িয়েছি, সেই জায়গাগুলোই হয়ে ওঠে রহস্যময়।
লাইটের আলোটা একটু জোরালো হলেও ভয়টা একটু কম লাগত। এমন ভয়ংকর নির্জনতায় অ্যাডভেঞ্চার তখন মাথায় উঠেছে। ভাবছি একশো একুশ কোটির ভারতবর্ষ এত নির্জন কেন! কতক্ষণ আর গল্প করা যায়। প্রকৃতির এমন একটা জায়গায় এসে সব কথাও যেন ফুরিয়ে গেছে। এমন পরিবেশে কথা বলতেও ভয় লাগে। অনেক কষ্টে সন্ধ্যে সাতটা বাজল। চারিদিক দেখে মনে হচ্ছে গভীর রাত। চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ছে জঙ্গলে। ভাবলাম ক্যান্টিনে গিয়ে কেয়ারটেকারগুলোর সঙ্গেই গল্প করি। গল্প না করলেও অন্তত দু-চারটে লোকের মাঝে তো থাকা যাবে। দেখলাম তারা রান্নায় ব্যাস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই রান্না শেষ। আবার তারা চলে যাবে নিজেদের ঘরে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম যে এই ঘুটঘুট অন্ধকারে তারা এখন বাড়ি যাবে! তারাও খুব সহজ সুরেই ‘হ্যাঁ’ বলল। তাদের মুখের মধ্যে এবং কথার মধ্যে ভয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। ক্যান্টিনে এসে তাও দু-চারটে লোকের মুখ দেখে একটু সাহস হয়েছিল। এখন তাদের চলে যাবার কথা শুনে আবার ভয়ের চোরাস্রোত শুরূ হল।
Emerald Forest
একটি মাত্র নেপালী দারোয়ানই নাকি রাত্রে থাকে। ক্যান্টিনের পেছন দিকেই তার ঘর। সে আমার ভয়ের কথা শুনে তার জীর্ণ ঘরে আমাদেরকে নিয়ে গেল। সে সারাদিন সুরাপান করে। আর মনের আনন্দে থাকে। তার ঘরও দেখলাম সুরার গন্ধে পরিপূর্ণ। সেদিন তার ঘরে একটি বাঙালি ড্রাইভার আশ্রয় নিয়েছিল। যারাই গাড়ি নিয়ে সুনতালেখোলা বেড়াতে আসে তাদের সেই ড্রাইভাররা এই নেপালী দারোয়ানের ঘরেই থাকে। তার সঙ্গে বেশ খানেক্ষণ গল্পগুজব করা হল। তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জেনে আমরা বেশ খুশিই হলাম। বিস্তর কথাবার্তার পর দেখা গেল সময় মাত্র সাড়ে আটটা। সকলেরই খাবার এবং ঘুমের সময় হয়ে গেছে। আমরাও তাই গুটিগুটি পায়ে দেশিমুরগীর ঝোল সহযোগে ভাত খেয়ে নিলাম। খাবার পর ওই ঘেরাটোপের মধ্যেই পায়চারি করতে লাগলাম। জঙ্গলে তখন ডাইনী জ্যোৎস্নার তীব্র আলো। পাহাড়, জঙ্গল, নদী সেই অপরূপ জ্যোৎস্নায় স্নাত হচ্ছে। কিন্তু বাইরে বেরোবার সাহস কিছুতেই পেলাম না।  
শীত এখানে এতটাই তীব্র যে তিনটে ব্ল্যাংকেট নিয়েও হাত পা হিমশীতল লাগছে। অদ্ভুত অজানা এক আরণ্যক ভয়ের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ি আমি। সকালের আলো চোখে পড়তেই রাতের ভয় কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গরম গরম চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ি রাস্তা ধরে। পাহাড়ের এক এক বাঁকে একরকম সৌন্দর্য। রাতের শিশির স্নাত গাছ আর সকালের রোদ মিলিয়ে বেশ একটা বন্য গন্ধের মধ্যে দিয়ে আমরা পথ হাঁটছিলাম। কিছুটা দূরেই একটা ছোট্ট বাজারের মত আছে। স্থানীয় কিছু মানুষের জনবসতি। সেখানে এক বয়স্ক নেপালী আন্টির দোকানে মোমো খেলাম। নেপালী আন্টির আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। পাহাড়ী জায়গায় মোমোর স্বাদ সাধারণ মোমোর তুলনায় অনেক সুস্বাদু। মোমো আর কফি খেয়ে কমলালেবুর উদ্দেশ্যে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম মণ্ডল গাঁ এর উদ্দেশ্যে।
হাঁটা না বলে ট্রেকিংও বলা যায়। কমলালেবু কিনে খাওয়া আর গাছ থেকে পেড়ে খাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। হাঁটতে হাঁটতে কত রংবেরঙ্গের ফুল  আমাদের স্বাগত জানাল। যেন ঈশ্বরের ফুলদানি। মাঝে মাঝে থেমে  তাদের সঙ্গে ছবি তোলা হল। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে পথের ওপরেই দুদণ্ড বসে বিশ্রাম নেওয়া। তার পর আবার হাঁটা শুরু। পথ আর শেষ হয় না। ব্যাপারটা একদম মরুতীর্থ হিংলাজের মতো। কমলালেবুরও আর দেখা পাওয়া যায় না। সমতলে হাঁটা আর পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার মধ্যে পার্থক্য আছে। অবশেষে পথ ফুরোল। যেখানে ফুরোল সেখানেই বেশ উঁচুতে একটা শিব মন্দির রয়েছে। এমন নির্জন এবং এমন শান্ত সুন্দর শিব মন্দির আগে দেখিনি। চারিদিকে অপূর্ব ফুলের সমারোহ। শিবমন্দিরের শান্ত শীতল ঠাণ্ডায় পথের ক্লান্তি অনেকটা চলে গেল। দেখলাম শিব ও পার্বতী শুকনো মুখে বসে আছে। আমি তাদের জন্য মিষ্টি বা সন্দেশ কিছুই আনিনি। গোটাকতক নকুলদানা ডিশে পড়ে রয়েছে। পিঁপড়েরাই সেগুলো মহানন্দে খেয়ে চলেছে। আমার কাছে পাল্‌স্‌ চকলেট ছিল। সেগুলোই দুজনকে দুটো দিয়ে এলাম। বললাম ‘খেয়ে নাও। দারুণ টেস্ট। হজমও ভাল হবে।’
মন্দির থেকে বেরিয়ে দেখলাম স্থানীয় কিছু ভুটানী মানুষদের জনবসতি। তাদের তখন সেখানে বিচার সভা বসেছিল। বিচার সভাটি বেশ অদ্ভুত। রাজাদের মত পোশাক পরা দুজন লোক একটি বেশ বড় ছাতার তলায় বসে সব শুনছে। আর তাদের ভাষায় কীসব যেন বলছে। এসব দেখে আমরা ফিরে আসছি। মনে দুঃখ। কমলালেবুর গাছ দেখতে পাইনি। কিন্তু প্রচুর স্ট্রবেরি গাছে দেখলাম। এমন সময় একটা বাঁক ঘুরতেই কমলালেবু গাছে চোখে পড়ল। গাছটা বেশ হলুদ হয়ে আছে। যাবার সময় কেন  জানি না চোখে পড়েনি। দু চারটে লেবু পাড়া সত্ত্বেও দেখলাম গৃহকর্তী কিছু বলল না। অনেক কষ্টে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে চরণ বাবুর ট্যাক্সিতে চেপে ফিরা এলাম কটেজে।
Jungle Camp
 বিকেল বেলা দেখি সেই নদীর কোলে ছোট্ট একটি উনুন জ্বেলে এক ছোকরা মোমও, আর কমলালেবু বিক্রি করছে। সে তার মোমো বিক্রির জন্য এত সুন্দর একটি জায়গাকে বেছেছে দেখে বেশ আনন্দিতই হলেম। অনেক পর্যটক এই ঝুলন্ত ব্রিজের আকর্ষণে আসছে, ছবি তুলছে, মোমো খাচ্ছে আর চলে যাচ্ছে। আমাদের দেখে তাদের একটু হিংসেই হয়ত হয়েছিল। সকলেই সেই কটেজগুলো বাইরে থেকে দেখছে আর ভাবছে এখানে যারা থাকছে তারা কত লাকি! আমিও মনে মনে বলছি একদিন থাকো। বিকেল পাঁচটার পর টের পাবে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেই সকালের পাড়া লেবু গুলো খেতে গিয়ে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। এত টক যে পাতিলেবুকেও হার মানায়। তখন বুঝলাম কেন গৃহকর্তী লেবু পাড়া সত্ত্বেও লাঠি নিয়ে তেড়ে আসেনি।
 সেদিনও বেশ তাড়াতাড়িই সন্ধ্যে নেমে এল। আমাদের সঙ্গে যে দু-চারজন এখানে বেড়াতে এসেছিলেন তারাও সেদিন সকালেই চলে গেছেন। সেই ড্রাইভারও বিদায় নিয়েছে। ফলে টুরিস্ট বলতে কেবল আমরা আর সবেধন বাবা নীলমণি সেই নেপালী দারোয়ান। সময় কিছুতেই আর কাটে না। ভেবেছিলাম নির্জন প্রকৃতির মাঝে গিয়ে বই পড়ব। কিন্তু ওই ভয়ংকর ঠাণ্ডা আর তীব্র নির্জনতায় বই পড়া তখন মাথায় উঠেছে। গান শুনতেও ইচ্ছে করছে না। খাওয়া দাওয়ার পর কর্তার কাছে অতিরিক্ত ভয়ের জন্য যথেষ্টরকম অপমানিত হয়ে জঙ্গলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। রবি ঠাকুর গেয়েছিলেন ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’। বিভূতিভূষণ এমন জ্যোৎস্নাতেই জঙ্গলের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। আর বুদ্ধদেব গুহ এমন জায়গায় এমন রোমহর্ষক পরিবেশে এলে নিশ্চয় আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস লিখে ফেলতেন। আমিও তাই সাহসে ভর করে জঙ্গলে গেলাম। সেই ঝুলন্ত সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে নদীর জলে চাঁদের ঝরে পড়া দেখতে লাগলাম। সেই সময়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা আমার অসাধ্য।
এই জঙ্গলের রাস্তায় আমি কর্তার সঙ্গে হাঁটতে ভয় পাচ্ছি। অথচ ওই নেপালী দারোয়ানগুলো কী অবলীলায় ওই অন্ধকারে পাহাড় নদীর মধ্যে দিয়ে শর্টকাট রাস্তা আবিষ্কার করে আসা যাওয়া করে। ভয় কোনওভাবেই তাদেরকে গ্রাস করে না।
তারপর পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। কলকাতার জনঅরণ্যে বসে যখন সুনতালেখোলার কথা ভাবি মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। এই ঘন ঘোর বর্ষায়, কেমন আছে আমার সুনতালেখোলা! নগর সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন এক নির্জন পাহাড়ী জঙ্গলে যে নেপালী দারোয়ান পরিবার থেকে দূরে একলা বছরের পর বছর ধরে সরকারি চাকরি করছে; সে কীভাবে থাকে ওই ভয়ংকর জায়গায়! জীবনে সে কী পেল! পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে, ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করতে গিয়ে, আমাদের শহুরে মানুষদের সমস্ত অসুবিধার অবসান করতে গিয়ে নিজের জীবনটাই তো সে উৎসর্গ করে দিতে বসেছে। অথচ দুঃখের কোনও ছাপ নেই তার মধ্যে। সে মহানন্দে আছে। দুদিন কাটাতেই আমাদের যেখানে মনে হল দুবছর কেটে গেল সেখানে হাজার অসুবিধের মধ্যে ওই সহজ সরল মানুষগুলি কেমন করে থাকে! কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। সদা হাস্যময় এক নির্ভীক নেপালী মানুষ। যার কথা ইতিহাসের কোথাও কোনওদিন লেখা থাকবে না।
কীভাবে যাবেন?‌
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে নিউ মাল জংশন। সেখান থেকে গাড়িতে মোটামুটি এক ঘণ্টার পথ। শিলিগুড়ি থেকেও গাড়িতে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে খরচ কিছুটা বেশি।
কোথায় থাকবেন?‌
পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের কটেজ আছে। রিভারক্যাম্পও আছে। সাহসী ও  অ্যাডভেঞ্চার–‌প্রিয় হলে রিভার ক্যাম্পে থাকুন। নইলে, কটেজে থাকাই ভাল। এছাড়া বেশ কিছু হোম স্টে তৈরি হয়েছে। সেখানেও থাকতে পারেন। তবে হোম স্টে–‌তে সেই রোমাঞ্চ পাবেন না। খরচ একটু বেশি হলেও সরকারি কটেজে থাকাই ভাল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here