মিনি লন্ডন : ম্যাকলাসকিগঞ্জ

4
336
“দিনের শেষ গাড়ি মরা বিকেলের হলুদ অন্ধকারে একটু আগে চলে গেছে। এখন প্লাটফর্ম ফাকা। এখানে ওখানে দু-একজন ওঁরাও মেয়ে-পুরুষ ছড়িয়ে আছে। কার্নি মেমসাহেবের চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। আসন্ন সন্ধ্যার অস্তমিত আলোয় প্লাটফর্মের ওপারের শালবনকে এক অদ্ভুত রহস্যময় রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। চারদিক থেকে বেলাশেষের গান শোনা যাচ্ছে “। এই রকমই ছিল বুদ্ধদেব গুহর ম্যাকলাসকিগঞ্জ(MacCkluskiganj)।
ম্যাকলাসকিগঞ্জ(MacCkluskiganj) ছোট এক জনপদ অধুনা ঝাড়খন্ড(Jharkhand) রাজ্যের। প্রায় ৬৪ কি মি / ৪০ মাইল এর দূরত্ব রাজধানী রাঁচি(Ranchi) শহর থেকে। এই বনাঞ্চল এক সময় ব্রিটিশদের মৃগয়াভূমি ছিল। পরবর্তীকালে তাদের আসাযাওয়া আরো বারে রেললাইন পাতার কাজে। ক্রমে এই বনপাহাড়ে আকৃষ্ট হতে থাকে তারা। ১৯৩৩ সালে কলকাতা(Kolkata) নিবাসী এক anglo indian” প্রপার্টি ডিলার “(জমি ব্যাবসায়ী) ই.টি.ম্যাকলাস্কি(Earnest  Timothy MacCluski ) রাতুর(Ratu) মহারাজের থেকে ৯ টি গ্রাম প্রায় ১০০০০ একর জমি লিজে নেন এখানে anglo indian  কলোনি গড়ে তুলবেন বলে। তৈরী করেছিলেন “Colonisation society of India “–co-operative , anglo indian দের “Mooluk”(মুলুক ! দেশের প্রায় সকল anglo indian  পরিবারকে এর সম্মন্ধে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। প্রায় ৪০০ (400) পরিবারের বাস ছিল এক সময় এই সাহেব কলোনিতে। তারা এই Co-operative এ  শেয়ার কিনে নির্দিষ্ট “প্লট ” পেত। কৃষিজমি ৫০ টাকা ও বাস্তুজমি ২৫০ টাকা। ফ্রেঞ্চ ও পর্তুগিজ রাও খুব কম সংখ্যায় হলেও জমি কিনেছিলেন এই অনন্য সুন্দর জায়গায়। তাদের দেশের সঙ্গে যেন কোথায় মিল ছিল এই স্থানের। নির্জন,মনোরম,ঢেউ খেলানো অরণ্য পাহাড়। তিরতির করে বয়ে চলা নদী-নালা। বছরভর আরামদায়ক আবহাওয়া। বাতাসে আদ্রতা কম। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো ম্যাকলাস্কির নাম “মিনি ইংল্যান্ড” নামে। যারা আবেদন করে বসবাস শুরু করলেন তারাই ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন তাদের সাধের ম্যাকলাস্কি কে। MacCkluski  সাহেবের নামে এই জায়গার নাম হয়ে উঠলো “ম্যাকলাস্কিগঞ্জ”(MacCkluskiganj)।
MacCkluskiganj Railway Station
পিয়ানো, বলডান্স, ফ্রুটকেকের সুগন্ধ, ওয়াইন গ্লাসের রিনরিনে আওয়াজে ভরে থাকতো ম্যাকলাস্কির আকাশ-বাতাস। গাউন পরা মেমরা সাদা ফ্রিল করা ছাতা ,সাদা গ্লাভস পরে বৈকালিক ভ্রমণে যেত গঞ্জের উপান্তে । অপূর্ব সব বাংলোয় সন্ধেবেলা ঝাড়বাতি ঝুলতো বারান্দা ও গার্ডেনের চারপাশে। তারা তাদের বাগান বা “গার্ডেন”কে দুর্দান্ত সব ফুলে ভরিয়ে রাখতো। তার সুবাসে মম করতো গঞ্জের রাস্তা,গলি। পুরুষরা শিকারে যেত কাছের জঙ্গলে বা ছোট মাছ ধরতো “চাট্টি” ও “ডেগাডেগি” নদীতে। এক স্বপ্নের জায়গা ছিল তখন “ম্যাকলাসকিগঞ্জ”(MacCkluskiganj)!
সমস্যা শুরু হয় ১৯৩৪ সালে ম্যাকলাস্কি  সাহেবের মৃত্যু ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। অধিকাংশ পরিবার গঞ্জ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেয়। ম্যাকলাস্কি  সাহেবের ইচ্ছা ছিল তার সাধের গঞ্জকে এক কৃষি সাবলম্বী গ্রাম হিসাবে গড়ে তুলতে। তার সেই পরিকল্পনা মতোই একর একর জমি দেয়া হয়েছিল যারা কিনেছিলেন সেই জমি। বাংলোবাড়িতে ফুল-ফল বিক্রি করে তাদের যে আয় হতো এক সময় , ম্যাকলাস্কি সাহেবের মৃত্যুর পর তা পরিকল্পহীনতায় ভুগতে লাগলো। কর্মসংস্থানের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে। সাহেবদের কর্মবিমুখতা তাদের সর্বনাশ ডেকে আনলো। ফলতো তারা তাদের বাড়ি-ঘর হয় বিক্রি করে নয়তো তাদের চাকরদের দান করে বিদেশে পাড়ি দিলো। ম্যাকলাসকিগঞ্জ(MacCkluskiganj) তার গরিমা হারালো। জমজমাট এক anglo  কলোনি থেকে নিঝুম গ্রামে রূপান্তরিত হলো সেই জায়গা। আজও সেইসব কলোনিয়াল স্মৃতি নিয়ে ২০টা পরিবার বাস করে ম্যাকলাসকিগঞ্জে।

.

Nostalgic colonial structure
৬৬ বছরের “Kitty Texaria “কে বলা হয় “Face of MacCkluskiganj ” । আজও দেখতে পাবেন কিটি ম্যাম তার পোষ্যদের নিয়ে মলিন শাড়ি পরে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের স্টেশনে বিকেলে পায়চারি করতে এসেছেন। কিটি ম্যাম এর স্টেশনে একটা ফলের দোকান আছে যা দিয়ে তার দিনগুজরান হয়। ক্ষয়ে যাওয়া বাংলোবাড়ির একঅংশে সে থাকে তার মেয়ে,নাতনি ও তার পোষ্য ছাগল ও মুরগিদের নিয়ে। ম্যাকলাসকিগঞ্জ আজও সুন্দর ! শাল-মহুয়ার অরণ্যে ঘেরা শান্ত ,নির্জন এক স্থান। সাহেবদের পুরোনো বাংলোগুলো বড়ই স্মৃতিমেদুর করে তোলে পর্যটকদের। দুদণ্ড দাঁড়ালেই মনে আসবে এই সব বাড়িতেই এক সময় কত প্রেম, ভালোবাসায় ভরে থাকতো।  আজ শুধুই নির্জনতা ! এখানকার যে কবরস্থান রয়েছে সেখানে আজও anglo  সাহেব-মেমরা তাদের পূর্বসূরিদের মনে করতে ফুল নিয়ে ঢোকে। চুপ করে বসে প্রার্থনা করে তাদের প্রিয়জনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। “কঙ্কার” গির্জায় ঘন্টা বাজে “ঢং”,”ঢং” করে। সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পরে পাশের টিলা,অরণ্য,পথঘাটে।
এখানে একটা স্কুল আছে “জাগৃতি বিহার”(Jagriti Bihar)। ১৯৯৭ সালে শ্রী সচিদানন্দ উপাধ্যায় এটা প্রতিষ্ঠা করে।স্থানীয় আদিবাসীদের উন্নয়ন ও পড়াশোনা শেখানোই এদের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি স্থানীয় মহিলাদের বিভিন্ন হাতের কাজ শিখিয়ে স্বনির্ভর করে তোলা। এছাড়াও আদিবাসী যুবকদের নেশামুক্ত সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানও করে থাকেন এরা।
Kitty mam with her pets
Kitty mam at her ancestral home
“এ জায়গাটায় সকাল হয় না , সকাল আসে। অনেক শিশিরঝরানো ঘাসে ভেজা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে অনেক শঙ্খিনী নদী পেরিয়ে সোনা-গলানো পোশাক পরে সকাল আসে এখানে ……..ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রতিটি সকাল আমার জন্য যেন কি এক আনন্দের পসরা সাজিয়ে আনে। প্রতিদিন এই ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে পুবের ও পশ্চিমের পাহাড়ের রোঁয়া রোঁয়া স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে আমি বারে বারে নিজেকে ভুলে যাই “। আপনারও এমনি অনুভূতি হবে ম্যাকলাসকিগঞ্জে আসলে। এই অঞ্চল মূলত মুন্ডা-ওরাঁওদের বাসভূমি। তাদের রীতি-রেওয়াজ মুগ্দ্ধ করবে। সাহেব পরিবারের কেউ মারা গেলে তারা ধামসা-মাদল বাজিয়ে শেষ যাত্রায় সামিল হয় আজও। এছাড়া নিজেদের অনন্যসুন্দর কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তো আছেই। পূর্ণিমার রাতে সাহেব বাংলোর বারান্দায় বসে পাশের গ্রামের ধামসা-মাদলের শব্দে বিভোর হয় শহুরে মন।
পাশেই রয়েছে “চাট্টি”। তিরতিরে ক্ষীণতোয়া এক নদী। পায়ের পাতা ভেজানো জল। ছড়ানো ছিটানো নানান ধরণের পাথর। দুই পাশে অরণ্যের গার্ড অফ অনার। ঘুরে আসুন , ভালো লাগতে বাধ্য। কিছুদূরে আছে “ডেগাডেগি” নদী। তার উপরে ছোট ব্রিজ। টিলা ও জঙ্গলে সাজানো এর দুই পাশ। “ডেগাডেগি” কথার অর্থ “লাফালাফি” বা “লম্ফঝম্ফ “। বাংলার “ঘাগড়াতে” যেমন নদী পাথরে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে বছরের পর বছর প্রাকৃতিক ঘর্ষণের ফলে , এখানেও তেমনি সব পাথরে ছোট-বড় গর্তে ভরা। স্থানীয় মানুষজন অবশ্য বিশ্বাস করে অশরীরীর লাফালাফির ফলে এই সব গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
Duli village
Landscape of MacCkluskiganj

“কুমারপাত্রা” আরেক নদী ম্যাকলাসকিগঞ্জের। এখানকার ভূমিরূপ অনেকটা মার্কিনদেশের “কলোরাডোর” মত। এখানেও প্রাকৃতিক ক্ষয়ে সৃষ্টি হয়েছে অপুরূপ সব নদী-পাথরের কারুকাজ। এর পর “হেসালং” ওয়াচ টাওয়ার। এখন থেকে সমগ্র ম্যাকলাসকিগঞ্জ  কে পাখির চোখে দেখা যায়। ম্যাকলাসকির যে মূল তিনটে গ্রাম বা বসতি — হেসালং , লাপড়া ও কনকা , তিনটেই দৃশ্যমান এই নজরমিনার থেকে। কাছেই “নাট্টা” পাহাড়। এখানে একটা টেকিং রুট আছে। ঢেউয়ের মত হাইওয়ে পেরিয়ে , মায়াপুরের জঙ্গল এর ভিতর দিয়ে পৌঁছানো যায় এই পাহাড়ে। যা শোনা যায় এখানকার সূর্যাস্ত অসাধারণ। আরো দূরে পালামৌ(Palamau) এর “মহুয়াটার”(Mahuadanr) এর অরণ্যের হাতছানি। ম্যাকলাসকির “দুলি” গ্রাম বিখ্যাত তার মন্দির , মসজিদ ও গুরুদুয়ারার উপস্থিতি একই স্থাপত্যের মধ্যে। ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন হিসাবে এর উপস্থিতি আজকের ভাতরবর্ষের প্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক ! এ ছাড়াও দেখতে পারেন কঙ্কনা সেন শর্মার “A death in the gunj ” এর শুটিং কোথায় কোথায় হয়েছিল , কোনখানে কলাকুশলীরা ছিলেন ইত্যাদি।বুদ্ধদেব গুহর যে বাড়ি ছিল “টপিং হাউস “, যেখানে বসে উনি লিখেছিলেন “একটু উষ্ণতার জন্য” সেটাও দেখতে পারেন। যদিও সে বাড়ি আর বুদ্ধদেব গুহর নেই।

Awesome MacCkluskiganj

রাত নেমে আসে ম্যাকলাসকিগঞ্জে। দূর থেকে ভেসে আসে আদিজনের সুর মূর্ছনা। রাত বারে মাদলের স্বরও চড়ে। নিভুনিভু আলোয় বাংলোগুলো কেমন যেন মায়াবী হয়ে যায়। এখানেই তো এক সময় নিপুন হাতের আলতো ছোয়ায় বেজে উঠতো পিয়ানোর সিম্ফনি। বাড়িগুলোর লনে সাহেব-মেমরা বলনাচের আসরে মাতিয়ে তুলতো এই নিঝুম গঞ্জকে। শেষ বাসটা আজও চলে গেলে সাহেব পাড়ায় নেমে আসে অপার নিস্তব্ধতা। দূরে অল্প আলোর বাসস্ট্যান্ডে একদিন “ছুটি” এসে নেমেছিল ! “ছুটি এখন পর্দা-টানা ঘরে নরম বেড-লাইটের আলোয় রুদ্রর বুকে অশেষ আশ্লেষে ঘুমিয়ে আছে ,পরম নিশ্চিন্তে ,উষ্ণতায়। ছুটি ? আমার ছুটিও কি সত্যিই সুখী হয়েছে ?” আর ঠিক তখনি Pat  Glaskin এর শেষ কথাগুলো মনে পড়বে,”Show me the way to go home , I am tired , And I want  to go to bed , show me the way to go home “

Advertisement
Advertisement

4 COMMENTS

  1. অপূর্ব লিখেছো শুভদা। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের গন্ধও পেলাম যেন। এত সুন্দর ডিটেইলড ভ্রমণকাহিনী সচরাচর দেখা যায় না। তোমার লেখার ফ্লেভার অনন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here