যেখানে সমুদ্র হোটেলে এসে পা ধুয়ে দিয়ে যায়

0
198
কথায় আছে, ‘ঘরের কাছে যার স্টেশন, সেই ট্রেন ফেল করে’। আমার অবস্থা অনেকটাই যেন সেরকম। এই বাংলায় সমুদ্র যে জেলায়, সেই জেলাতেই আমার জন্ম। অর্থাৎ, পূর্ব মেদিনীপুরে(East Midnapur)। সেখানেই বেড়ে উঠেছি। কিন্তু, ঘরের কাছে সমুদ্র থাকার পরেও সেভাবে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি।
অথচ, ছোটবেলায় বারবার দিঘায়(Digha) গেছি। কাছেই বাড়ি। অনেকটা যেন এপাড়া থেকে ওপাড়ায় ঘুরে আসা। তাই রাতে হোটেলে থাকার দরকার পড়েনি। সারাদিন ঘুরেছি,আবার  সন্ধ্যে নাগাদ ফিরেও এসেছি, কখনও বাসে, কখনও বন্ধুর বাইকে। জোয়ারের সময় দিঘার উত্তাল চেহারাও দেখেছি। ওল্ড দিঘায় দেওয়ালের গায়ে কীভাবে ঢেউগুলো ধাক্কা মারে, কীভাবে জল ছলকে এপারে চলে আসে, সেই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু এবার সমুদ্রকে দেখলাম আরও কাছ থেকে। না, এবার আর দিঘায়(Digha) নয়, মন্দারমণিতে(Mandarmani)। 
কাজের সূত্রে কলকাতায়(Kolkata) থাকা। আর দু’চারদিন ছুটি পেলে বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসা। একেবারে ছকে বাঁধা জীবন। এবার অতিমারির আনলক-টু চলাকালীন বাড়ি যাবার আগের দিন একটা ফোনেই সেই রুটিনটা একেবারে বদলে দিল। ফোনটা করেছিল আমার এক পরিচিত বন্ধু কাম দাদা। সে বাঁকুড়ার(Bankura) ছাতনায়(Chatna)  থাকে। দু’তিনদিন হাতে সময় পেলেই মনের আনন্দে এদিক-ওদিক বেরিয়ে পড়ে। অন্য কোনও নেশা নেই, ঘুরে বেড়ানোই একমাত্র নেশা। কথায় কথায় তাঁকে বললাম, কাল বাড়ি যাব ভাবছি। আমার কথা শুনে ওই দাদা বলল, ‘আরে আমারও আগের দু’সপ্তার ছুটি নেওয়া হয়নি। আর এই সপ্তার ছুটি মিলিয়ে তিনদিনের ছুটি। ভাবছি, তোমাদের জেলাতেই যাব, আর এই জন্যেই তোমাকে ফোন করলাম। চল, তাহলে চল কাল আমরা একসঙ্গেই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি’। এরপর ওই দাদা  বললো, ‘তুমি আগে মন্দারমণি(Mandarmani) গেছ তো?’ আমি একবারও যাইনি শুনে একটু অবাক হয়ে বলল, সে কি! নিজের জেলার এত সুন্দর জায়গাটায় যাওনি? এরপরই প্রস্তাব দিল, ‘তাহলে তোমার কোনো অসুবিধা না থাকলে আমায় সঙ্গ দিতে পারো। একটা দিন মন্দারমণিতে(Mandarmani) কাটিয়ে পরদিন বাড়ি যেতে পার’।
আসলে মেদিনীপুরে জন্ম হলেও পারিবারিক কারণে আমার বেড়ে ওঠা ভিন রাজ্যে। এর ফলে বহুদিন ঘরের বাইরেই কেটেছে। আবার নিজের রাজ্যে ফিরে আসার পর এখন বেশিরভাগ সময়টা কাটছে কলকাতায়। তাই সেভাবে মন্দারমণি যাওয়ার সুযোগটাই হয়নি। আবার সুযোগ এলেও মনে হয়েছে, বাড়ির কাছেই তো, পরে না হয় কোনও এক সময় যাওয়া যাবে। কারণে অকারণে লম্বা ছুটি পেয়েছি, কিন্তু ‘হোম সিক’ হয়ে দেশের বাড়িতে গিয়ে শুয়ে বসে আয়েশ করে দিনগুলো কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছি। কথায় আছে, ‘সাধা অন্ন পায়ে ঠেলতে নেই’- এই প্রবাদবাক্য মনে করেই দাদার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। আমার কোনও চাপ নেই। চিন্তা করবেন চিন্তামণি।
Where sky meets Sea
কীভাবে গেলামঃ
ঠিক হল, কলকাতা থেকে আমরা খুব সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব এবং দুপুরের আগেই পৌঁছে যাব। সেইমত, সকাল ৬ টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ধর্মতলার সরকারী বাস টার্মিনাসে। বাঁকুড়া(Bankura), বীরভূম(Birbhum), দুর্গাপুর(Durgapur), দীঘার(Digha) বাস দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টার থেকে সময় জেনে একেবারে টিকিট কেটে বাসে উঠে বসলাম। বাস ছাড়ার পর সকালবেলার স্নিগ্ধ কলকাতাকে বেশ ভাল লাগছিল। কোলাঘাটে এসে আমাদের বাস প্রথমবার থামলো। সাময়িক বিরতি। ওখানে হাল্কা স্ন্যাক্স আর ভাঁড়ে চা খেয়ে আবার বাসে উঠে বসলাম। তারপর নন্দকুমার(Nandakumar) ও কাঁথি(Contai) হয়ে নামলাম চাউলখোলায়(Chaulkhola)। সেখান থেকে অটোতে মন্দারমণি। আমি এখানে আসিনি ঠিকই। তবে আমার ওই দাদা আগে অনেকবারই এসেছে। ফলে, বেশ চেনাজানা। গিয়ে উঠলাম একেবারে সমুদ্রের লাগোয়া একটা হোটেলে। একপাশে রাস্তা। অন্যপাশে সমুদ্র। আ-হা-হা। হোটেলের এত কাছে সমুদ্র! কিছুটা অবাকই হলাম। সেই দাদা বলল, এখন তো ভাঁটা চলছে। জোয়ার আস্তে দাও, দেখবে সমুদ্র কত কাছে এসে ধরা দেবে। এই হোটেলের ভেতর চলে আসবে। এত কিছু না জানলেও এটা জানতাম যে এখানে হোটেলগুলো একটাও নাকি সরকারী নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি।  সমুদ্রতীরে বালিয়াড়িতে দেখলাম প্রচুর লাল কাঁকড়া।
যেদিকের গেটে সমুদ্র, তার বাইরেই একটা ঝুপড়ি দোকান। নিচটা ফাঁকা। বাঁশ আর হোগলা পাতা দিয়ে একটা মাচা তৈরি করা।। এটা অমিয়দার হোটেল। সেই মাচার ওপর পাতা আছে প্লাস্টিকের চেয়ার, টেবিল। শুনলাম, সেই মাচার তলা দিয়ে সমুদ্রের জল যায়। একদিকে জলের গর্জন, অন্যদিকে খাওয়া দাওয়া। মনে মনে ভাবলাম, বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার তো!
আমরা যখন গেলাম, তখন সেই হোগলা পাতার মাচা ঘরে দেখলাম তিন পুরুষ ও তিন নারী গুলতানি করছে। কখনও বিয়ার, কখনও মাছভাজার অর্ডার করে যাচ্ছে। দোকানি আর তার গিন্নি অনবরত সবকিছু জোগান দিয়ে যাচ্ছে। কেউ অফিসের গল্প করছে। কেউ কোনও আত্মীয়ের গল্প শোনাচ্ছে, আবার কেউ মোবাইলে মজে আছে। উপর দিকে তাকাচ্ছেই না। কেউ আবার সেলফি তুলে হয়ত সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়তে চাইছে।
যাক, এসব কথা। আমরা একপ্রস্থ চা খেয়ে সোজা ঝাঁপ দিলাম সমুদ্রে। বিপদ এড়াতে সরকার সব সৈকতে জলে নামার ক্ষেত্রে একটু কড়াকড়ি করেছে। তবে আমরা নামার সময় ভাঁটা চলছিল। ভাঁটার সময় কড়াকড়ি  তেমন থাকে না। মনে হল, দিঘার তুলনায় মন্দারমণিতে ঢেউ অনেকটাই শান্ত। আধ ঘন্টা জলে থেকে হোটেলে ফিরে শরীরের নুন জল ধুয়ে আর এক প্রস্থ স্নান সেরে চলে এলাম অমিয়দার সেই ঝুপড়ি হোটেলে। কী আশ্চর্য, ওই ছ’জন তখনও আপন মনে খেয়ে চলেছে। মনে হল, বেলা দু’টোর পরেও যখন ‘ফোয়ারা আনলিমিটেড’ তার মানে এটাই এদের ব্রেকফাস্ট, এটাই লাঞ্চ, হয়ত বা ডিনারও।
Silhouette sea shore
খাওয়া দাওয়াঃ
আমরা হোটেলে খাওয়ার পাট রাখিনি। কারণ, দাম অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, মশালাদার রান্না। আর, ফ্রিজ না থাকায় এখানে আগের দিনের বাসি খাবার গরম করে চালানোর কোনও গল্প নেই। তাই আমাদের পছন্দ ছিল অমিয়দার হোটেল। গরম গরম ভাত, ডাল, আলুভাজা সঙ্গে দেশি মুরগির ঝোল। সবমিলিয়ে অপূর্ব বলতে আমার দ্বিধা নেই। ডায়েট, স্বল্পাহার ইত্যাদি ভুলে অনেকটাই খেয়ে ফেললাম। এদিকে তখন জোয়ার আসছে। সমুদ্রও আমদের দিকে এগিয়ে আসছে। যেখানে স্নান করেছিলাম, এখন সেটাকে অনেকদূর মনে হচ্ছে। হোটেলে এসে একটু বিশ্রামের পর বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে লাগলাম বাঁদিকের রাস্তা ধরে। সৈকতের অপূর্ব বিকেল আমাদের শরীরের সব গ্লানি যেন ধীরে ধীরে দূর করে দিচ্ছে। শুনশান পথ। এদিকটায় পর্যটকদের তেমন ভীড় নেই। লাল কাঁকড়া আপন মনে খেলা করে চলেছে। আমাদের পদশব্দে ওরা দ্রুত গর্তে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য অপূর্ব। আমরা সহজে চোখ ফেরাতে পারছি না। সূর্য ধীরে ধীরে অস্তগামী। ক্রমশঃ তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম, লাল টকটকে সুর্য সমুদ্রর জলে ডুবে গেল। আমরা এবার পা চালালাম। কিছুদূর গিয়ে আরও একটা চালা ঘরের দোকান পাওয়া গেল। সেখানেও চেয়ার, টেবিল পাতা। বাঁশে দড়ির দোলনা। আয়েস করে অলস সময়ে দোলনায় নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। ব্যস্ততা তো অনেক দেখেছি। এই নির্জনতাও যে বড় সুন্দর। সমুদ্রের গর্জনে পাখির ঘরে ফেরার ডাক চাপা পড়ে যাচ্ছে। বিকেল একটু একটু করে ছোট হতে হতে গড়িয়ে গেল সন্ধ্যের দিকে। দুপুরে দেখা সেই নারী-পুরুষদের কথা মনে পড়ে গেল। দুপুরে গড়িয়ে  যাওয়ার পরেও মাছভাজায় মজে থাকারা এই ভর সন্ধ্যায় হয়ত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। 
একটু একটু করে এগিয়ে আসছে সমুদ্র, আসছে জোয়ার। আর সৈকতে থাকা নিরাপদ নয়। কারণ, সৈকতের পরেই রয়েছে  বড় বড় সব বোল্ডার। সেখানে একবার আছাড় খেলে আর দেখতে হবে না। তাছাড়া, ভাঁটার সময় সমুদ্রকে যতটা সুবোধ বালক মনে হচ্ছিল, জোয়ারে ততটাই যেন সৃষ্টিছাড়া। কাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলবে, কেউ জানে না। কোনও সাঁতার, কোনও জারিজুরি কাজে আসবে না। সৈকত ছাড়িয়ে ঢেউ এগিয়ে এল পাড়ের দিকে। একে একে আছড়ে পড়ল সেই দেওয়ালে। ওল্ড দিঘায় (Old Digha)যে গর্জন দেখেছিলাম, আবার সেই গর্জন ফিরে আসছে। এখন আর সৈকত ধরে হোটেলে ফেরার কোনও উপায় নেই। ঘুর পথে রাস্তা দিয়েই ফিরতে হবে। হোটেলে ফিরে দেখি, হোটেলের দেওয়ালে এসে থামছে সেই ঢেউয়ের সারি। এখানে অধিকাংশ হোটেলেরই সমুদ্রের দিকে ছোট ছোট চালাঘর করা আছে। মূলতঃ, বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরি। মাথায় হাল্কা একটা বাতি। বুঝতে অসুবিধা হয় না কাদের জন্য এই আয়োজন। উইকএন্ডে নিশ্চয়ই  এগুলো ভরে যায়। এখন সপ্তাহের মাঝামাঝি তাই ভিড়টা একটু কম।    
রাতে আবার ডাক পড়লো অমিয়দার হোটেলে। এবার সমুদ্র একেবারেই উত্তাল চেহারায়। মাচার ওপর জল উঠে যাচ্ছে। সেই জলে আমাদের পা ভিজে যাচ্ছে। এখানে এরা দিনের পর দিন কীভাবে কাটায়! এমনকি রাতেও এই মাচাতেই শুয়ে থাকে। নিচ দিয়ে উত্তাল সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে। বাঁশের মাচায় এভাবে এত নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকা যায়! আমাদের তো হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ধন্যি ওদের সাহস। সমুদ্রই ওদের এই সাহস দিয়েছে। 
রাত তখন সাড়ে এগারোটা। সমুদ্র আসতে আসতে পিছিয়ে যাচ্ছে। হোটেলের কেয়ারটেকার ইতিমধ্যেই তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। অমিয়দা বললেন, চিন্তা নেই  অন্যদিকে রাস্তা আছে, আমি দেখিয়ে দেব। অন্য এক হোটেলে ঢুকে ছোট্ট একটা পাঁচিল টপকে আবার ফিরে এলাম নিজেদের হোটেলে। ঝোড়ো একটা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এভাবেই আরও কিছুক্ষণ সেই বাঁশের বেড়াঘরে বসে থাকলাম।
Sky above, Sand below, Peace within
কোথায় থাকবেনঃ
সকালে আবার সাতটা নাগাদ জোয়ার আসবে। তাই ভোর ভোর উঠেই বেরিয়ে পড়লাম। এবার ডান দিকে। একের পর এক হোটেল। সবমিলিয়ে অন্ততঃ শ’ দেড়েক হবে। একদিনের থাকার খরচ? চিন্তা করবেন না, মোটেই আকাশছোঁয়া নয়। মোটামুটি ভাল মানের হোটেলে ডাবল বেডের ঘর সাতশোর মধ্যে পেয়ে যাবেন। আবার আরও বেশি টাকা খরচ করতে চাইলে তেমন হোটেলের ব্যাবস্থাও আছে। পেয়ে যাবেন চার তারা বিশিষ্ট হোটেলও আপনাকে উষ্ণ আপ্যায়ন জানাতে তৈরি। তবে হোটেলের নামগুলো বড়ই অদ্ভূত। দিঘায়(Digha) বা পুরীতে(Puri) যেমন বাঙালি নামের ছড়াছড়ি, এখানে তেমনটা নয়। অধিকাংশতেই বিদেশি নামের ছোঁয়া। প্রায় সব হোটেলেই সমুদ্রের দিকে চেয়ার পাতা। কোথাও কোথাও গোয়ার সি বিচের মতো একটু দামী গার্ডেন চেয়ার। তবে, আমরা যেখানে ছিলাম, তার বিশেষত্ব হল, এখানে হোটেলের বাইরে অমিয়দার সেই ঝুপড়ি দোকান বা হোটেল ছিল। কিন্তু এই সব হোটেলের বাইরে কোনও দোকান নেই। হোটেলের ঝাঁ চকচকে রেস্তোরায় খাওয়া যাবে ঠিকই। তবে পায়ের তলায় সমুদ্র, নেই। নেই সেই গা ছমছমে অনুভূতি।
পরদিন তখনও সকালের আলো সেভাবে ফোটানি। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। সমুদ্র সৈকত ধরে হেঁটে গেলাম অনেকটা পথ। সমুদ্র সৈকতের ভোর একেবারেই অন্যরকম। কত মন কেমন করা স্মৃতি যে উস্কে দিচ্ছিল ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে। কাল সূর্যাস্ত দেখেছি। আজ  সূর্যোদয় দেখবো। অতিমারী! না, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তকে আটকানোর কোনও ক্ষমতাই তার নেই। স্নিগ্ধতার চাদরে মোড়া শহর থেকে বহুদূরের এক অন্য পৃথিবী।
Home is where the anchor drops......

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here