তাবাকোশি

0
118
মাইলের পর মাইল চা বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। গতবছর এইসময়। তখন লকডাইন ছিল না, করোনা ছিল না। কয়েকদিনের জন্য নিশ্চিন্ত জীবন। মনে হয়েছিল, জীবনটা আমার বলেই তো মন খুলে এভাবে ঘুরে বেড়াতে পারছি। এই গরমে একটু হিমেল হাওয়া, একটু ভেসে বেড়ানো মেঘ। ভিনদেশ বা ভিন রাজ্য নয়, একেবারেই মিরিকের লাগোয়া ছোট্ট অচেনা, নাম না জানা তাবাকোশি (Tabakoshi) গ্রামে তিনদিনের জন্য গিয়েছিলাম।  নামটা প্রথম শুনছেন, তাই তো? কলকাতার এক খবরের কাগজের উত্তরবঙ্গের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিক বন্ধুর কাছে তাবাকোশি (Tabakoshi) নামটা আমিও প্রথম শুনেছিলাম। শিলিগুড়ির শিবমন্দির অঞ্চলে একটা ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে সাংবাদিক বন্ধু একাই থাকে। তাই ক’দিনের উত্তরবঙ্গে গিয়ে এনজেপি-তে নেমে অটো নিয়ে সাতসকালে সোজা ওর ওখানেই হাজির হয়েছিলাম। 

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমদের নানারকম আলোচনা হচ্ছিল। একসময় বলল, ‘ক’দিন আগে তাবাকোশি থেকে ঘুরে এলাম, চমৎকার জায়গা’। আমি বললাম- তাবাকোশি (Tabakoshi)? সে আবার কোথায়? বন্ধুটি বলল, মিরিকের কাছে। তখনই মনে হলে ঘুরে এলে হয়। আমি তাবাকোশির (Tabakoshi) প্রেমে পড়ে গেছি দেখে বলল, ‘যাবে নাকি’? বললাম- দেখো, শিলিগুড়িতে যে কাজে এসেছি তার জন্য আমায় তিন-চার দিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, আমার দুর্ভাগ্য যাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, এখানে এসে তাঁকে টেলিফোন করে জানলাম, গতকাল তিনি কলকাতায় গেছেন এবং দিন তিনেক পর ফিরবেন। তাই ভাবছি- এখানে বসে থাকার চেয়ে অন্ততঃ দুটো দিন বরং কোথাও ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। আমার বন্ধুটি বলল, ‘ঠিক আছে, তাহলে কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়। শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যান্ড থেকে শেয়ারে একটা গাড়ি ধরে আগে মিরিক বাজার পর্যন্ত চলে যাও। ওখান থেকে কিছুটা ভেতরে যেতে হবে। সে ব্যাবস্থা আমাদের ফটোগ্রাফার বিকাশ করে দেবে’।

বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি! পৃথিবী ছেড়ে দিন। এই বাংলারই বা কতটুকু জানি! আবার সেই রবি ঠাকুর -‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’। আকস্মিকভাবেই পৌঁছে গিয়েছিলাম তাবাকোশি (Tabakoshi)। আপনারা যাঁরা আসবেন, তাঁরা জানেন যে, কলকাতা থেকে নিউজলপাইগুড়ি(এনজেপি) অনেকভাবেই আসা যায়। ট্রেনে রাত ১০-০৫ মিনিটে দার্জিলিং মেল শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে পরদিন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছয়। শিয়ালদহ থেকে পদাতিক এক্সপ্রেস রাত ১১টায় ছেড়ে পরদিন সকাল দশটার মধ্যে পৌঁছয়। আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাঞ্চনকন্যা, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, তিস্তা তোর্সা। হাওড়া থেকে পাবেন সরাইঘাট এক্সপ্রেস। বিমানে যেতে হলে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট-এ নেমে তাবাকোশি (Tabakoshi) কিংবা মিরিক বাজার পর্যন্ত শেয়ারে বা পুরো গাড়ি বুক করে যেতে পারেন। এছাড়া কলকাতা থেকে বাসেও যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে শিলিগুড়িতে নেমে তেনজিং নোরগে থেকে শেয়ার গাড়িতে উঠে মিরিক বাজারে নামুন। মাথা পিছু ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। তবে কলকাতা থেকে ট্রেনে এসে এনজেপি’তে নেমে সরাসরি গাড়ি বুক করে তোবাকোশি যেতে চাইলে ২৫০০-৩০০০ টাকা ভাড়া। সব থেকে ভাল উপায়, শিলিগুড়ি থেকে শেয়ারে মিরিক বাজার নেমে বাকি ৮কিমি পথ ক্যাবে যান। শেয়ারে মাথা পিছু ভাড়া ১৫০-২০০টাকা। 

কোথায় থাকবেন- তাবাকোশি মানেই অজস্র টি এস্টেট। অনেক বাগান মালিকেরই আছে গেস্ট হাউস। আছে হোম স্টে। কম ও বেশি ভাড়ার হোম স্টে। অ্যাটাচড বাথ। সহজেই পেয়ে যাবেন। ডাবল বেডের মাথা পিছু ভাড়া দিনে ভাড়া ১২০০টাকা, আর ট্রিপল বেডের মাথা পিছু ভাড়া ১৩০০টাকা। আপনি নিভৃতে একটু একা থাকতে চান? সে ব্যবস্থাও আছে। তবে প্রতিদিনের জন্য ভাড়া ১৫০০টাকা। আরও আছে। হোম স্টে’তে না থেকে, তাঁবুতে থাকার ইচ্ছা হলে সে ব্যাবস্থাও আছে। চারজনের জন্য তাঁবুর ভাড়া তিনহাজার। চার বেলা খাবার খরচের টাকা আলাদা করে দিতে হয় না, ভাড়ার টাকার মধ্যেই ধরে নেওয়া হয়। তবে তাঁবুতে থাকলে খাবার আলাদা খরচ আছে। এছাড়া বেশি স্বাছন্দ পেতে বেশি ভাড়ার হোম স্টে’ও পাবেন। এখানে অনেক হোম স্টে’রই নিজস্ব সব্জির বাগান

জৈবসারে চাষ করা একদম টাটকা শাকসব্জি। নিরামিষ পদগুলো খুবই সুস্বাদু। আমিষের ক্ষেত্রে ইলিশ, পাবদা পাবেন না, তবে রুই, কাতলা চিংড়ির মত মাছের দেখা পাবেন। মুখে লেগে থাকে সুস্বাদু মাছের ভাজা ও ঝোল। আগে বলে দিলে উত্তরবঙ্গের দুস্প্রাপ্য বোরোলি মাছের দেখাও পেয়ে যেতে পারেন। সকালে চা আর বিস্কুটের কিছু পরে প্রাতঃরাশঃ টোস্ট, ডিমসেদ্ধ, মিষ্টি ও কলা। কখনও চাউমিন, সঙ্গে দুটো মিষ্টি কিংবা কমলার জুস। আপনি নিরামিষাশী হলে গরম গরম ভাত, ডাল, ক্ষেতের শাকভাজা, দু’রকমের তরকারি ও শেষ পাতে দই। আর আমিষাশী হলে দু’রকমের বদলে একটা তরকারি সঙ্গে মাছ বা চিকেন ও দই। বিকালে ঘরে থাকলে মন ভোলানো গরম চা,সঙ্গে সামান্য কিছু স্ন্যাক্স। আর রাতে আপনি ভাত বা রুটি যা খেতে চান আগে বলে দিতে হয়। কেউ কেউ অবশ্য রাতে ভেজ বা নন ভেজ এক প্লেট মোমো খেতে চান। এক প্লেটে বেশ বড় সাইজের আট পিস মোমো খেলেই তো পেট ভর্তি।   

তাবাকোশি (Tabakoshi) কেমন জায়গা? ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রামের ছবি যেমন হওয়ার কথা, তেমনিই। পাহাড়ি মানুষগুলো বড় ভালো। সহজ, সরল আর আন্তরিকতার তো কোনও তুলনা নেই। ইচ্ছামতো টি এস্টেটগুলো ঘুরে দেখুন। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। একটা দিন ক্যাব ভাড়া করে তাবাকোশির সব কিছু ঘুরে দেখতে পারেন, ক্যাবের ভাড়া ২০০০টাকা। না হলে, লামলামে ঝর্ণার ভিউ পয়েন্টে যেতে পারেন।  রাংব্যাং নদীর তীরে বিষ্ণু ও শিবমন্দির দর্শন সেরে ওখান থেকে নদীর ওপরে আয়রণ ব্রিজের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ভরে উপভোগ করুন। দুপুরে হোমে ফিরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে একটু গড়িয়ে নিয়ে মিরিকের দিকে ক্যাব নিয়ে যান। পথে পড়বে সিমনা ভিউ পয়েন্ট। পাশেই ওখানকার বাজার। স্থানীয়দের তৈরিই সবকিছু শুধু বিক্রি হয়। ইচ্ছা হলে ঘুরে দেখুন। ওখান থেকে বেরিয়ে মাথাপিছু ৪০টাকা ভাড়ায় অটো নিয়ে চলে আসুন নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির দর্শনে। পাশেই নেপাল সীমান্তে পশুপতি মার্কেট। বাজার করতে ভালবাসলে, কেনাকাটায় উৎসাহ থাকলে পছন্দমত কেনাকাটা করে ফিরে আসুন।

আবার, অনেকেরই এত দৌড়ঝাঁপ করতে ইচ্ছা হয়না। তাঁদের কাছে তাবাকোশি (Tabakoshi) মানে প্রকৃতির মাঝে দুটো দিন শুধুই হারিয়ে যাওয়া। আমাদের রাজ্যে ‘টি ট্যুরিজিম’ সেভাবে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু না, এখানেই শেষ নয়। বাগানের মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া, হাত ধরে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ কোথায়?  

কীভাবে যেন ঘোরের মধ্যে দুটো দিন কেটে গেল। তৃতীয় দিন ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। আমি যেখানে আছি, সেই গেস্ট হাউসের অনেকেই বেরিয়ে এসেছেন। সেই চেনা আন্তরিকতা, চেনা সারল্য, চেনা হাসি। সবই আমাদের জন্য। কাজ সেরে আজ অথবা কাল রাতেই শিলিগুড়িকে বিদায় জানাব আমিও। দ্রুত সামনের পথ ধরে এগোতে এগোতে পেছন ফিরে দেখলাম, হাত তুলে সবাই বিদায় জানাচ্ছে। আমিও সুখের স্মৃতি আগলাতে যন্ত্রের মতো হাত নাড়তে নাড়তে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম।      

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here