Boguran: অপরিচিত বগুরানে….

লেখা – কস্তুরী চক্রবর্ত্তী / ছবি – সমীরন চক্রবর্ত্তী

শীতের হাতছানি পরতেই মনটা কেমন ভ্রমন পিপাসু মনে হয়। হিমেল হাওয়ায় মনটা কেমন ছটফট্ করতে থাকে বেড়ানোর জন্য। কী জানি কোন যাদু আছে এই হাওয়ার স্পর্শে। এর ছোঁয়ায় মনের যত ক্লান্তি, গ্লানি সব মুছে দেয়। ঠিক  এই সময়েই আমার ভ্রমনপ্রেমী পতি সমীরন আমাকে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমার ঝিমিয়ে পরা মনটা যেন আচমকা জেগে উঠলো। কোথায় যাবো একবারও প্রশ্ন না করেই ঘাড়টা ডান দিনে হেলিয়ে দিলাম।

আমরা কয়েকটি পরিবার রওনা হলাম ২৭ অক্টোবর কাকভোরে। জায়গাটার নাম আগে দু-একবার শুনলেও মনে রাখতে বড়ই বেগ পেতে হচ্ছিল। আসলে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে জায়গাটাকে জানার সুবন্দোবস্ত থাকলেও, কেনো জানিনা আমার ইচ্ছে করেনা। এর পেছনে একটা অন্য হেতু আছে! আমার নিজস্ব অনুভূতি হলো, সেই নতুন জায়গাটায় পৌঁছে নিজে চাক্ষুষ করে যে আনন্দ, তা আগে জানা থাকলে পাবো না।

চারচাকায় চড়ে কলকাতা থেকে প্রায় ১৬০ কিমি দূরের বগুরান-জলপাই আমরা ঘন্টা চারেকেই পৌঁছে গেলাম। এখানে আসার আরেক  উপায় হলো, হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে নামতে হবে কাঁথি। বেশ কয়েক জোড়া ট্রেন আপনাকে দু-আড়াই ঘন্টায় পৌঁছে দেবে।এখান থেকে বগুরানের দূরত্ব মাত্র ১৪ কিমি। পাওয়া যায় অটোরিকশা। বগুরান-জলপাই এ থাকা-খাওয়ার একমাত্র ভরসাযোগ্য জায়গা ‘হোটেল সাগর নিরালায়’। এখান থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে বঙ্গোপসাগর।

শান্ত, নির্জন স্হান, সাজানো রিসর্ট আর মনোরম পারিপার্শ্বিক পরিবেশে মনের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। লটবহর ঘরে রেখেই বেড়িয়ে পরলাম সবাই মিলে। শুনেছিলাম এখানে খুব নিরালা একটা সৈকত আছে। যাওয়ার পথে দেখলাম কিছু ঘর বাড়ি ও তার চারপাশে আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, কাজুবাদাম, শিরিষ, নিম, কামরাঙা, আকাশমণি, ছাতিম ও বেশ কিছু সংখ্যক প্রকান্ড ঝাউ গাছে ঘেরা ছবির মতন সাজানো ছোট্ট এক জনপদ। বনদপ্তরের একটা চৌকিও এখানে আছে।

কর্মমর গৃহবধূর মন কাজের ফাঁকে সর্বদাই খোঁজে ছোট্ট অবকাশ। আর দু’দিনের এই ছুটিতে মন যদি জঙ্গল ও সমুদ্রকে যুগপৎ খুঁজে পায় তাহলে তো সে আত্মহারা হবেই। নিমেষেই পৌঁছে গেলাম বালুকাবেলায়। ভাটার টানে নোনাজল তখন বেশ খানিকটা দূরে হলেও বালি-কাদা-ঝিনুক আর মিঠে রোদ্দুর কে সঙ্গী করে মন্দ লাগছিল না সৈকতে হাঁটতে।

পাশেই আছে প্রকৃতির সাজানো ঝাউগাছের জঙ্গল। হঠাৎ নজর কাড়লো কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি! মাটিতে লুটিয়ে উড়ে যেন ইতি-উতি চলেছে। অবাক হলাম। এ তল্লাটে তো কৃষ্ণচূড়া গাছ নজরে আসেনি! মনে বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে গেলাম আর কাছে পৌঁছে আবিষ্কার করলাম দলে দলে লাল কাঁকড়া। খুব সুন্দর সে দৃশ্য, দেখে আনন্দ পেলাম আর আমরা সবাই মোবাইল ও ক্যামেরায় তাদের নানান দৃশ্য বন্দী করতে লাগলাম। মাথা তুলতেই নজরে পড়লো সারি সারি বিশালাকৃতির মাছ ধরার জাহাজ। ভাল লাগাটা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল। 

আমাদের সাথের কচিকাঁচারা সেই দৃশ্য দেখে আনন্দে হুল্লোড় শুরু করে দিল। এমনিতেই জল-বালি-ঝিনুক নিয়ে তাদের আহ্লাদের শেষ নেই, তার সাথে জাহাজের আবির্ভাব ওদের উপরি পাওনা হলো। সাগর এখানে এতই শান্ত যে, ছোটোদের নিশ্চিন্তে ছেড়ে দেওয়া যায় খেলতে। ওরাও স্বাধীন ভাবে খেলতে পেয়ে যেন স্বাধীনতার সুখ চেটেপুটে খেলো। এটাই বগুড়ানের সৈকতের বিশেষত্ব বলা যায়।

 

উপকূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটাই এসে গেছি আমরা, সঙ্গী সমীরণ । হঠাৎ হাত তুলে দেখালো দূরের পিছাবনী নদী, সমুদ্রের সাথে কোথায় মিলেছে। আর ওখানেই আরও কিছু মাছ ধরার ট্রলারকে অপেক্ষা করতে দেখলাম। এদের বেশির ভাগেরই রঙ্ কমলা। ইচ্ছে করছিল ঐ নদী ও সাগরের  মিলনের জায়গায় পৌঁছে যেতে। কিন্তু সময় বাধ সাধলো। পা’দুটোও জবাব দিচ্ছিল। 

শুনলাম সেথায় যেতে আরও ঘন্টা দেড়েক লাগবে। তাই মনের মোড় ঘোরালাম, মোহনা মনের কোনেই পরে রইল। দেখতে দেখতে কীভাবে যে তিন-চার ঘন্টা কেটে গেছে ঠাহরই করতে পারিনি। এবার ফিরতে হবে। সাগরের বিশালত্বকে বুকে চেপে ধরে গুটি গুটি পায়ে এসে পৌঁছালাম হোটেলের রেঁস্তোরায়। এবার  মধ্যান্ন  ভোজনের পালা। দুপুরের খাওয়ার পরে  হোটেলের গাছেই লাগানো হ্যামকে দোল খেতে খেতে নজরে পরলো বেশ কয়েকরকম পাখিদের ওপর। অনেকেই চেনা। তবে স্কেলি ব্রেস্টেড মুনিয়া, সিনেরাস্ টিট্, রেখা বসন্তবৌরি, চাক দোয়েল এদের কয়েকজন কে ওখানেই প্রথম দেখলাম। এই পাখপাখালিদের দেখতে গিয়ে ঝাউ গাছের ফাঁকে ফাঁকে সুনীল আকাশকে দেখে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো। মনটা যে ঐ সমুদ্দুরের পানে পরে আছে…..তাই নিজের মনে গেয়ে উঠলাম -“সাগর ডাকে আয়-আয়-আয়…”।  তারপর সেই ডাক যদি কোমল হয়, তার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকি কি প্রকারে?

অন্যান্য সমুদ্রের যেমন গর্জন আছে, এর তেমন সেসব কিছুই ছিল না। অনেক মাথার ভীড় ওখানে নেই, আছে বিশেষ নির্জনতা। বিকেলের পরে আসা রোদ আর সূর্য্যকে অস্তাচলে যেতে দেখতে দেখতে নিজের মনের সাথে ভালোলাগাটা নিয়ে বেশ মাখামাখি করা যায়। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ছোটোদিনের বেলা, তাই ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে এলো। সেদিনটিতে কালি পূজো থাকায় সন্ধ্যে নামতেই সংলগ্ন মৎসজীবি গ্রামটি নিশ্চুপ হয়ে যায়নি। মাঝে মধ্যেই  আকাশ আলো করে আতসবাজির রোশনাই নজরে আসছিল। আমরা বাঙালি নামের সুনাম বজায় রেখে আড্ডা দিচ্ছিলাম গরমাগরম পেঁয়াজ পকোড়া ও ধূমায়িত চা সহযোগে।

পরদিন সকালে মিঠে রোদ আর জোয়ারে এগিয়ে আসা নোনা জলে পা ডুবিয়ে মন ভাসিয়ে বেশ কিছু নকশাকাটা ঝিনুক কুড়োচ্ছিলাম। মাথর উপর এত উজ্জ্বল নীল আকাশ মনে হলো আগে কখনও দেখিনি! আমার  আবেশের ঘোড় কাটলো দূর থেকে শুনতে পাওয়া সমীরনের ডাকে। আমার ছেলে অরন্য এগিয়ে এসে কানে কানে বললো – ‘বাবা অনেক আগে থেকেই নাকি চিৎকার করে হাতছানি দিয়ে ডাকাডাকি করছে তোমায়’ – বুঝলাম এবার আমাদের ফেরার পালা। ঘরে ফেরার বিষন্নতার মাঝেও অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে যাওয়ার আনন্দে আত্মাটা পরিতৃপ্ত হয়ে উঠেছিলো।

সমুদ্র কে আরও একবার দেখে নিয়ে সায়োনারা বলে মুখ ফেরালাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here